দৌড়ে সবার সেরা : গবেষণায় উদ্ভাবিত হলো সবচেয়ে দ্রুতগতির ডাইনোসর পা ও পদক্ষেপের দৈর্ঘ্যের উপর ভিত্তি করে গতি নির্ধারণে নতুন জ্ঞান
সমাজকাল ডেস্ক:
ডাইনোসরদের সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলাতে শুরু করেছিল ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে। একসময় বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন, ডাইনোসররা ছিল ধীরগতির, অলস প্রকৃতির ও ঠান্ডা রক্তবিশিষ্ট প্রাণী। কিন্তু ১৯৬৪ সালে মার্কিন জীবাশ্মবিদ জন অস্ট্রম ‘ডেইনোনাইকাস’ নামে একটি ভয়ংকর চটপটে ও হালকা-গঠনের শিকারি ডাইনোসরের জীবাশ্ম আবিষ্কার করলে সব ধারণা পাল্টাতে শুরু করে। এই আবিষ্কার জন্ম দেয় ‘ডাইনোসর রেনেসাঁ’ নামে একটি বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের।
এ ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি নতুন গবেষণায় উঠে এসেছে—সবচেয়ে দ্রুতগতির ডাইনোসর ছিল অর্নিথোমিমোসরিয়া গোত্রের সদস্য অর্নিথোমিমাস। এটি অনেকটা আজকের উটপাখির মতো দেখতে ছিল এবং ছিল দুই পায়ে চলাফেরায় অভ্যস্ত।
🧠 কেন দ্রুত ছিল অর্নিথোমিমাস?
যুক্তরাজ্যের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের প্যালিওনটোলজিস্ট সুসানাহ মেইডমেন্ট বলছেন, “অর্নিথোমিমাসদের গঠনগত বৈশিষ্ট্য ছিল গতি বৃদ্ধির জন্য আদর্শ। লম্বা, সরু পা ও পেশি সংযুক্তির স্থান পায়ের ওপর দিকে হওয়ায় এই পা দোলনার মতো কাজ করত, যা কম শক্তিতে বেশি গতি প্রদান করে।”
এদের দেহ ছিল হালকা ও সংকুচিত, যা চলাফেরায় সহায়ক ছিল। গঠনগতভাবে এরা ছিল শিকারি নয়, বরং দ্রুতগতিতে দৌড়ে শিকারি প্রাণীদের এড়িয়ে চলা সম্ভব হতো তাদের জন্য।
🔬 গতির গাণিতিক বিশ্লেষণ: বায়োমেকানিকসের ভূমিকা
ডাইনোসরের গতি নির্ধারণে আধুনিক গবেষণা যাত্রা শুরু হয় রবার্ট ম্যাকনিল আলেক্সান্ডার নামক এক ব্রিটিশ প্রাণীবিজ্ঞানীর হাত ধরে। তিনি বায়োমেকানিকস নামে একটি নতুন শাখার সূচনা করেন যেখানে পদার্থবিজ্ঞান ও প্রকৌশলের সূত্র ব্যবহার করে প্রাণীর চলাফেরার গতি বিশ্লেষণ করা হয়।
আলেক্সান্ডার প্রমাণ করেন—পায়ের দৈর্ঘ্য ও পদক্ষেপের দৈর্ঘ্যের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, “প্রাণীর গতি যত বেশি, পদক্ষেপ তত দীর্ঘ হয়।” এই সূত্রই পরবর্তীতে ডাইনোসরের গতিবিধি বুঝতে ব্যবহার করা হয়।
🚶♂ ট্র্যাকওয়ে বিশ্লেষণ বনাম বাস্তব গতি
গবেষকরা বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত ডাইনোসরের পায়ের ছাপ বিশ্লেষণ করে stride length বা পদক্ষেপের দৈর্ঘ্য ও পায়ের উচ্চতার তুলনা করে গতি নির্ধারণের চেষ্টা করেন। তবে ডা. মেইডমেন্ট বলেন, এই পদ্ধতি নিখুঁত নয় কারণ:
সকল ডাইনোসরের আসল পা পাওয়া যায়নি
- ভূমির গঠন ও পরিবেশের পার্থক্যে পদচিহ্নে বিকৃতি ঘটতে পারে
- অনেক সময় ছাপ পাওয়া যায় চলার সময়, দৌড়ানোর সময় নয়
- তবুও, এই পদ্ধতির মাধ্যমেই বিজ্ঞানীরা একটি অনুমানযোগ্য সীমারেখা নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
🦴 গতির গুরুত্ব: বিবর্তন ও টিকে থাকার গল্প
এই গবেষণাগুলো শুধু গতির হিসাব নয়, বরং এটি ডাইনোসরের জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস, শিকার থেকে পালিয়ে বাঁচার কৌশল এবং পরিবেশে টিকে থাকার মতো বিবর্তনীয় দিকগুলোকেও স্পষ্ট করে। অর্নিথোমিমাস যেমন শিকারি নয়, বরং দ্রুত গতিতে দৌড়াতে পারায় এটি নিজেকে রক্ষা করতে পারত। এর অর্থ দাঁড়ায়—সবচেয়ে শক্তিশালী নয়, সবচেয়ে অভিযোজিত প্রজাতিই টিকে থাকে।
সারসংক্ষেপে:
এই গবেষণা আবারও প্রমাণ করলো যে ডাইনোসররা ছিল কেবল বিশাল দেহের বিশাল প্রাণী নয়, বরং জটিল গঠন, অভিযোজনযোগ্যতা ও চটপটে গতি-সম্পন্ন প্রাণী। অর্নিথোমিমাস-এর মতো প্রজাতি প্রমাণ করে, প্রকৃতির গতিশীলতা ও বিবর্তন কীভাবে নির্ধারণ করে কে থাকবে, কে হারিয়ে যাবে।