২১ মে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

হজের সূচনা হয় যেভাবে

মাইসারা জান্নাত :

মহান আল্লাহর প্রতি নিখাদ ভালোবাসা, নিরঙ্কুশ আনুগত্য ও আত্মশুদ্ধির এক মহান ইবাদত হজ। পৃথিবীর ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকেই আল্লাহর বান্দারা এই পবিত্র ইবাদত পালন করে আসছেন। আদম (আ.)-এর মাধ্যমে কাবা ঘরের প্রথম ভিত্তি স্থাপন, ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর পুনঃনির্মাণ, হাজেরা (আ.)-এর সীমাহীন নির্ভরতা, ইসমাইল (আ.)-এর আত্মসমর্পণ এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে এর পূর্ণতা, সব মিলিয়ে হজ এক অনন্য ইতিহাসের নাম। এই মহান ইবাদতের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ তাদের অতীতের ঐতিহ্য, আত্মত্যাগের শিক্ষা এবং আল্লাহর প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্যের অঙ্গীকার নতুন করে স্মরণ করে। তাই হজের ইতিহাস জানা মানে আত্মপরিচয়ের শিকড়ে ফিরে যাওয়া, বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্ভাসিত হওয়া।

হজের সূচনা পৃথিবীর প্রথম মানব ও নবী আদম (আ.)-এর মাধ্যমে। মহান আল্লাহ তাকে আদেশ দেন পবিত্র কাবা ঘরের ভিত্তি স্থাপনের জন্য। এটি ছিল মানবজাতির জন্য প্রথম ইবাদতের ঘর। কালপরিক্রমায় এই ঘর বিলীন হলেও নবী ইব্রাহিম (আ.) ও তার পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর হাতে আল্লাহর নির্দেশে তা পুনঃনির্মিত হয়। সেই পবিত্র ঘরের চারপাশ ঘিরে গড়ে ওঠে হজের মহান আয়োজনের ভিত্তি।

আমরা যে পদ্ধতিতে হজ করি সেটা চালু হয় ইব্রাহিম (আ.)-এর মাধ্যমে। হজ সূচনার সেই বিশাল কার্যক্রম ছিল মহান আল্লাহর প্রতি ইব্রাহিম (আ.)-এর নিরঙ্কুশ আনুগত্যের গল্পে সমুজ্জ্বল। আল্লাহর নির্দেশে তিনি তার স্ত্রী হাজেরা (আ.) ও দুধের শিশু ইসমাইল (আ.)-কে নির্জন মরুভূমিতে রেখে আসেন, যেখানে ছিল না কোনো পানি, খাদ্য বা আশ্রয়ের বিন্দুমাত্র ব্যবস্থা। শিশু ইসমাইল (আ.)-কে তৃষ্ণায় ছটফট করতে দেখে মা হাজেরা (আ.) ছুটে চলেন সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে। তার এই অবিরাম দৌড়ের পর আল্লাহর অশেষ রহমতে ইসমাইল (আ.)-এর পদতলে শুরু হয় জমজমের প্রস্রবণ, যা এক অপূর্ব করুণা ও বরকতের নিদর্শন। আজও হাজিরা ‘সাঈ’ নামক এই স্মৃতিবিজড়িত আমল পালন করে তাদের আত্মত্যাগের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানায়।

এরপর আসে ইব্রাহিম (আ.)-এর শ্রেষ্ঠ আত্মোৎসর্গের অধ্যায়। স্বপ্নে আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করার জন্য প্রস্তুত হন তিনি। পিতা ও পুত্র উভয়ের আত্মসমর্পণ ইবাদতের প্রকৃত চেতনার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হয়ে চিরকাল ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবর। মিনার পথে শয়তান যখন বাধা সৃষ্টি করতে আসে, তখন ইব্রাহিম (আ.) দৃঢ়তার সঙ্গে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করে প্রতিরোধ করেন। আজও হাজিরা মিনার জামারাত স্থলে শয়তানকে প্রতীকীভাবে পাথর নিক্ষেপ করে সেই আত্মবিশ্বাসের পুনরাবৃত্তি করে।

কাবা ঘর পুনর্নির্মাণ শেষ করার পর ইব্রাহিম (আ.)-কে আল্লাহ আদেশ দেন মানবজাতিকে হজের জন্য আহ্বান জানাতে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং কৃশকায় উটের পিঠে চড়ে, দূর-দূরান্ত পথ অতিক্রম করে।’ (সুরা হজ ২৭)

হজের পূর্ণতা আসে ইসলামের সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে। হিজরি দশম বর্ষে তিনি বিদায় হজ পালন করেন এবং আরাফার ময়দানে দাঁড়িয়ে মানবজাতির জন্য সাম্য, ন্যায়বিচার এবং আল্লাহর প্রতি নিখাদ আনুগত্যের চিরন্তন বার্তা পৌঁছে দেন। তার সেই ভাষণ মানবাধিকার ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের অমর ঘোষণাপত্র হয়ে ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ মুসলিম পবিত্র হজে অংশগ্রহণ করেন। তারা কেবল একটি ইবাদত পালন করেন না; বরং ইব্রাহিমি আত্মত্যাগ, হাজেরার নির্ভরতা, ইসমাইলের নিষ্পাপ ধৈর্য এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর বিশ্বজনীন বার্তার উত্তরাধিকার বহন করেন। হজ তাই শুধু একটি রীতির নাম নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর আধ্যাত্মিক ঐক্য, ইতিহাস ও বিশ্বাসের নাম।