যেসব প্রযুক্তি বদলে দেবে আগামী বিশ্ব
রায়না নীলা:
আধুনিক বিশ্বে অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে আগামী। এরই মাঝে বিরতিহীন দ্রুত গতিতে তৈরি হচ্ছে নতুন নানা প্রযুক্তি। ভবিষ্যতের বিশাল প্রযুক্তিগত এই উন্নয়নের সঙ্গে দুর্দান্ত গেজেট সম্পর্কিত নানা ঘোষণাও পাল্লা দিয়ে আসছে প্রতিনিয়ত। ফলে এমন মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, প্রতিদিনের নতুন নতুন এই প্রযুক্তি ও আবিষ্কার হয়তো চিরতরেই বদলে দেবে আমাদের ভবিষ্যৎ। তখন বিস্ময়কর গতির বৈশ্বিক প্রযুক্তির এই জোয়ারে পথ হারানো খুব কঠিন হবে না হয়তো। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রোগ্রামের কথাই ধরা যাক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এমন এক প্রযুক্তি, যেখানে শব্দযুক্ত একটি প্রম্পটের সাহায্যে স্ক্র্যাচে কবিতা লেখা যায়। এছাড়াও রয়েছে থ্রিডি প্রিন্টের চোখ, নতুন হলোগ্রাম, গবেষণাগারে তৈরি খাবার এবং মস্তিষ্কের গতিবিধি পড়তে পারা রোবট।
নেক্রোবোটিকস
ভবিষ্যতের নতুন এই প্রযুক্তিগুলো কখনও কখনও চিন্তারও অতীত উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম। এক্ষেত্রে নেক্রোবোটিকসের ধারণার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কোনো মৃত জিনিসকে রোবটে পরিণত করার সঙ্গে এ ধারণা জড়িত। অবিশ্বাস্য শোনালেও, এই ধারণা পুরোপুরি বদলে দিতে পারে আগামীকে।
ভয়ঙ্কর ভৌতিক সিনেমার প্লটের মতোই বাস্তবে এই প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে গবেষকদের একটি দল মৃত একটি মাকড়সাকে রোবট সদৃশ গ্রিপারে পরিণত করেছেন। নতুন এই রোবটকে অন্য বস্তুকে তোলার ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। এই সক্ষমতা অর্জনের জন্য মাকড়সাটিকে ইনজেকশনের মাধ্যমে বাতাস দেওয়া হয়েছে। এ পদ্ধতি বেশ কার্যকরী। কারণ মাকড়সা তার শরীরের হাত পা প্রসারিত করার জন্য রক্তের ‘হেমোলিম্ফ’ সংস্করণ বাড়াতে হাইড্রলিক্স ব্যবহার করে।
তবে মৃত জিনিসকে রোবরটে পরিণত করার লোমহর্ষক এই ধারণা বর্তমানে একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে এ ধারণা বাস্তবে পরিণত হলে তা আমাদেরকে এমন এক ভবিষ্যতে নিয়ে যাবে, যেখানে বিজ্ঞানকে আরো এগিয়ে নেওয়ার কাজে মৃত সব প্রাণীকে ব্যবহার করা হবে। পুরোটাই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো মনে হচ্ছে, নাহ!
বালির ব্যাটারি
ভবিষ্যৎকে উন্নত করার প্রতিটি প্রযুক্তিই যে জটিল হবে এমন নয়। এর মধ্যে সহজ ও অত্যন্ত কার্যকর কিছু প্রযুক্তিও রয়েছে। এ ধরনের প্রযুক্তির মধ্য থেকে কয়েকজন ফিনিশ প্রকৌশলী এমন একটি প্রযুক্তি নিয়ে এসেছেন, যাতে বালিকে একটি বিশাল ব্যাটারিতে পরিণত করার উপায় খুঁজে পেয়েছেন তারা।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথমে ৪ বাই ৭ মিটার স্টিলের একটি কন্টেইনারে ১০০টন বালি স্তুূপ করেন এই প্রকৌশলীরা। এরপর বাতাস ও সৌরশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিশাল এই বালিরাশিকে উত্তপ্ত করা হয়, যাতে এই তাপকে স্থানীয় কোনো জ্বালানী কোম্পানির মাধ্যমে কাছাকাছি এলাকার সব ভবনকে উষ্ণ করার কাজে বিতড়ণ করা যেতে পারে। এ পদ্ধতিতেই দীর্ঘ সময়ের জন্য জ্বালানী সংরক্ষণ করা সম্ভব। এই পুরো প্রক্রিয়াটি প্রতিরোধক তাপ হিসেবে পরিচিত একটি ধারণার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে, যেখানে বৈদ্যুতিক প্রবাহের ঘর্ষণের মাধ্যমে কোনো উপাদানকে উত্তপ্ত করা হয়।
বালু ছাড়াও অতিপরিবাহী বা সুপারকন্ডাটিং নয় এমন কিছু পরিবাহী রয়েছে যা বিদ্যুৎপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি করে না। বালুর মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা এই তাপকে এই পরিবাহীগুলোর মধ্য দিয়ে বিদ্যুতে প্রবাহিত করে তপ্ত বা গরম করা হয়। যা পরবর্তীতে জ্বালানী বিদ্যুৎ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ই-স্কিন
কৃত্রিম এক চামড়া, যাকে বলা হচ্ছে ই-স্কিন। ভাবা যায়, এ চামড়ার সহায়তায় মুখোমুখি না থেকেও হাজারো মাইল দূরে থাকা আপনজন বা বন্ধু-বান্ধবকে আলিঙ্গন করা যাবে!
বিশ্বের যে প্রান্তেই আমরা থাকি না কেন, প্রযুক্তির সহায়তায় একে অপরকে দেখা বা মৌখিকভাবে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি। তবে দীর্ঘ দূরত্বে থেকেও একে অপরকে স্পর্শের অনুভূতি ভাগ করে নেওয়ার মতো নির্ভরযোগ্য কোনো পদ্ধতি এখনও আবিষ্কার হয়নি।
কিন্তু অসম্ভব শোনালেও, অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ববাসী বহু দূরে থেকেও স্পর্শের সেই কাঙ্ক্ষিত অনুভূতি পাবে বলে দাবি বিজ্ঞানীদের। এ অসম্ভবকে সম্ভব করতেই রাত- দিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন হংকংয়ের সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ইঞ্জিনিয়ার। তাদের হাতে তৈরি ওয়্যারলেসভিত্তিক এক ধরনের নরম ই-স্কিন বহুদূরে থাকা দুই প্রান্তের দুই আপনজনকে একদিন ইন্টারনেটের মাধ্যমে অলিঙ্গন করার স্বাদ এনে দেবে।
স্যাটেলাইট ক্যাটাপ্লট
কে ভেবেছিল যে, একটি মাত্র অস্থায়ী ক্যাটাপ্লটের মাধ্যমেই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপায়ে একদিন মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানো সম্ভব হবে। যদিও ক্যাটাপ্লটের চেয়েও অনেক বেশি স্মার্ট ধরনের প্রযুক্তি এরই মধ্যে আবিস্কারও হয়েছে।
এ প্রযুক্তিটি হলো স্পিনলঞ্চ। এটি এমন একটি প্রটোটাইপ সিস্টেম যা স্যাটেলাইট বা অন্য ধরনের পেলোডকে মহাকাশে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে এটি প্রচলিত রকেটে পাওয়া রাসায়নিক জ্বালানী ব্যবহারের পরিবর্তে স্বাভাবিক কৌশলের গতিশক্তি ব্যবহার করে থাকে। স্পিনলঞ্চ ঘন্টায় ৮ হাজার এবং গতিতে ১০ হাজার পেলোড স্পিন করতে সক্ষম।
যদিও মহাকাশের কক্ষপথে পৌঁছানোর জন্য পেলোডের ছোট রকেট ইঞ্জিনের প্রয়োজনীয়তা এখনও ফুরিয়ে যায়নি, তবে স্পিনলঞ্চের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার কল্যাণে সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ জ্বালানী ও অবকাঠামো হ্রাস করেছে এই সিস্টেম। এরইমধ্যে স্পিনলঞ্চ মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সঙ্গে একটি চুক্তিও সই করেছে। তবে সিস্টেমটি এখন পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে।
জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন
কোনো মানবদেহে শূকরের হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপনের ধারণাটি হয়তো খুব সুখের শোনায় না। তবে এটিই সবশেষ চিকিৎসা পদ্ধতি, যা দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করছে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের এ পদ্ধতিকেই বলা হয় জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন। এ পদ্ধতিতে একটি প্রাণীর শরীর থেকে কোষ, টিস্যু বা একাধিক অঙ্গ এনে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ঢুকিয়ে প্রতিস্থাপন বা জুড়ে দিয়ে তাকে সচল করা হয়। অস্ত্রোপচারের জগতে এ পদ্ধতিটিই ভবিষ্যতে বিপ্লব ঘটাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ ধরণের অস্ত্রোপচারে নানা পদ্ধতি রয়েছে। তবে এর মধ্যে এখনও পর্যন্ত সম্পন্ন হওয়া সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতির একটি হলো- একজন মানুষের শরীরে একটি শূকরের হৃদপিণ্ড ঢুকানো। অঙ্গ প্রতিস্থাপনের এই অস্ত্রোপচার এ পর্যন্ত দুবার সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে একজন রোগী মাত্র কয়েক মাস বেঁচে ছিলেন এবং দ্বিতীয় রোগী এখনও পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে রয়েছেন।
জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন অস্ত্রোপচারগুলোর ক্ষেত্রে কোনো প্রাণীর হৃদপিণ্ডকে তাৎক্ষণিকভাবে মানুষের শরীরের মধ্যে রাখা যায় না। এজন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে প্রথমে একাধিক জিন পরিবর্তন বা জিন-এডিটিং করার প্রয়োজন হয়। কিছু জিনকে হৃদপি- থেকে বের করে আনতে হবে। এরপর প্রতিরোধ সক্ষমতা অনুযায়ী, জীনের চারপাশে থাকা হৃদপিণ্ডের টিস্যুর অত্যাধিক বৃদ্ধি বন্ধ করতে হবে, যাতে ওই জিনের সঙ্গে মানুষের শরীরের জিনোমগুলোকে যুক্ত করা যায়।
বর্তমান বাস্তবতায় জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন সংক্রান্ত অস্ত্রোপচার ঝুঁকিপূর্ণ। আবার এতে দ্রুত সাফল্যেরও তেমন নিশ্চয়তা নেই। তবে বাস্তবতা যাই হোক, অদূর ভবিষ্যতে আমরা জেনোট্রান্সপ্লান্টেশনের মতো অস্ত্রোপচার হয়তো নিয়মিতোই দেখব পাব। সেক্ষেত্রে প্রাণীর দেহ থেকে টিস্যু বা হৃদপি- নিয়ে মানুষের দেহে প্রতিস্থাপন করার প্রয়োজন হবে।
এআই ছবির প্রজন্ম
মানুষের পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের কাজ করা এখন নতুন এক বাস্তবতা। এ তালিকায় নতুন যে শিল্পের বিকাশ ঘটেছে- সেটি হলো ছবির জগৎ। ওপেন এআই কোম্পানির গবেষকরা মানুষের মত চিন্তা করতে পারে এমন একটি মেশিন বা সফ্টওয়ার প্রোগাম তৈরি করেছেন, যা শুধুমাত্র শব্দযুক্ত প্রম্পট বা বর্ণণার ভিত্তিতে ইমেজ বা ছবি তৈরি করতে সক্ষম।
‘কাউবয় হ্যাটপরা একটি কুকুর বৃষ্টিতে গান গাইছে- এমন একটি বর্ণণা টাইপ করার সঙ্গে সঙ্গেই এর সঙ্গে মানানসই একটি সম্পূর্ণ আসল চিত্র পাওয়া যাবে। এমনকি কোন শিল্পের শৈলি ব্যবহার করে তার অনুরোধও ওই বর্ণনায় তুলে ধরা সম্ভব। তবে কৃত্রিম ছবি আঁকার এই প্রযুক্তিটি একেবারেই নিখুঁত নয়। এতে রয়েছে নানা সমস্যা। যেমন- কার্টুন চরিত্রগুলো নকশা করার ক্ষেত্রে দুর্বল প্রম্পট দেওয়া হয়েছিল এআইয়ে। ডাল-ই নামে পরিচিত এই প্রযুক্তিটি এখন উন্নয়নের দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে। এটিকে আরও উন্নত করার পরিকল্পনা নিয়ে এক দল কাজ করে চলেছেন।
ভবিষ্যতে আমরা হয়তো দেখতে পাব, এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ছবির প্রদর্শনীও আয়োজন করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে দ্রুত আসল ছবি পাওয়ার জন্য কোম্পানিগুলোকে ইন্টারনেটে মেমেজ তৈরি করায় অবশ্যই বিপ্লব ঘটাতে হবে। এরই সঙ্গে মিডজার্নি নামের আরেকটি এআই ইমেজ জেনারেটর প্রযুক্তিও রয়েছে। এটি সাধারণ বর্ণণার প্রম্পটসহ গথিক মাস্টারপিস তৈরি করে। এর মানে, আমরা সত্যিকার অর্থেই ভবিষ্যতে বসবাস শুরু করে ফেলেছি।
থ্রিডি- প্রিন্টেড খাবার
রাতে হঠাৎ ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে, ভবেছেন কী খাবেন? হাতের কাছে তেমন খাবারও নেই। ঠিক এমন সময় যদি দ্রুত ফ্রিডি লেজাওে রান্না করা কেকের টুকরো টেবিলে চলে আসে, তবে কেমন হবে? ভাবতেই শিহরিত হচ্ছেন, তাই না।
হ্যা, এমন অসম্ভবকে সম্ভব করতেই কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং-এর একদল গবেষক কাজ করে চলেছেন। তারা এমন একটি ডিভাইস এরইমধ্যে তৈরি করেছেন , যা খাবারের কালি বা রং ব্যবহার করে সাত উপাদানের তৈরি একটি চিজকেক তৈরি করতে পারে। একটি লেজারের সাহায্যে সেটিকে আবার বেকও করা যায়। কলা, জ্যাম, চিনাবাদামের বাটার ও নিউট্রিলার মতো উপাদান দিয়ে এই সুস্বাদু কেক তৈরি করেছেন তারা।
একদিন এই থ্রিডি প্রযুক্তির কেক হয়তো সবার জন্য নিয়মিত বানানো হবে বাড়িতে। সেদিন যাদের হাতে খাবার তৈরির সময় কমা, পেশাদার অ্যাথলেট বা রোগীর পথ্যের তালিকায়ও যদি এই কেক দেখা যায়, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।