২ জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৮ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
Tafi

মাফ করবেন মি. গেটস, আপনার বিলিয়ন ডলারে আফ্রিকা রক্ষা পাবে না

মাফ করবেন মি. গেটস, আপনার বিলিয়ন ডলারে আফ্রিকা রক্ষা পাবে না, আপনার বিলিয়ন ডলারে আফ্রিকা রক্ষা পাবে না। খারাপ শাসন ও রাজনৈতিক দায়মুক্তি যেখানে সবকিছু ধ্বংস করে চলেছে, সেখানে বিদেশি সাহায্য কিছুই করতে পারবে না।

তাফি মাখাকা

২ জুন, ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবায় আফ্রিকান ইউনিয়নের সদর দপ্তরের নেলসন ম্যান্ডেলা হলে এক অনুষ্ঠানে বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তি ও বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস ঘোষণা দেন, আগামী দুই দশকে তাঁর প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আফ্রিকার প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার উন্নয়নে ব্যয় করা হবে। এটি তাঁর সেই অঙ্গীকারের অংশ, যা তিনি ৮ মে করেছিলেন—২০৪৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর তার ফাউন্ডেশন বন্ধ হওয়ার আগে তিনি প্রায় সমস্ত সম্পদ দান করবেন।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মোজাম্বিকের সাবেক ফার্স্ট লেডি এবং নারী ও শিশু অধিকারকর্মী গ্রাসা মাশেল। তিনি একে এক ‘সঙ্কটময় মুহূর্ত’ বলে বর্ণনা করে বলেন, “আমরা গেটস সাহেবের এই রূপান্তর যাত্রায় আমাদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতির ওপর ভরসা করছি।”

গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে গেটস ফাউন্ডেশন আফ্রিকায় কাজ করে যাচ্ছে—বুরকিনা ফাসো, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, সেনেগাল ও দক্ষিণ আফ্রিকায়। পুষ্টি, স্বাস্থ্য, কৃষি, পানি ও স্যানিটেশন, লিঙ্গ সমতা ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মতো বিভিন্ন খাতে তাদের প্রকল্প রয়েছে। কৃষিতে শুধু তারা ৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। তবু এই প্রচেষ্টা নিয়ে আফ্রিকা ও আন্তর্জাতিক মহলে বিস্তর সমালোচনা রয়েছে।

বিশেষ করে AGRA (Alliance for a Green Revolution in Africa)-র মাধ্যমে গেটস ফাউন্ডেশন যে গ্রিন রেভল্যুশন মডেল চালু করেছে, তা নিয়ে রয়েছে গভীর উদ্বেগ। ২০০৬ সালে রকফেলার ও গেটস ফাউন্ডেশন মিলে এটি চালু করে। উদ্দেশ্য ছিল ২০২১ সালের মধ্যে সাব-সাহারান আফ্রিকার ১১টি দেশে ৩০ মিলিয়ন ক্ষুদ্র কৃষক পরিবারের দারিদ্র্য ও খাদ্যাভাব দূর করা। কিন্তু ১৯ বছর পরেও এই কৃষি রূপান্তরের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি।

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই মডেল শুধু ব্যর্থ নয়—বরং খারাপ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে। ঋণগ্রস্ত কৃষক, কীটনাশক ব্যবহারের বৃদ্ধি, পরিবেশ বিপর্যয়, ফসলের বৈচিত্র্য হ্রাস, এবং বহুজাতিক কোম্পানির খাদ্যব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ—এসবই এর ফল।

এটা অবাক করার মতো নয়। গেটস যে কৃষি মডেল ব্যবহার করছেন, তা ১৯৪০-৫০-এর দশকের মার্কিন ‘গ্রিন রেভল্যুশন’ থেকে উদ্ভূত—যা বসতিস্থাপনভিত্তিক কৃষি ও বর্ণবাদী ক্ষমতার কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। এর ফলে স্থানীয় জ্ঞান ও আদিবাসী পদ্ধতির প্রতি অবমূল্যায়ন সৃষ্টি হচ্ছে।

ফাউন্ডেশনের প্রকৃত উপকারভোগী মূলত পশ্চিমা গবেষক, ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা ও কৃষি প্রযুক্তি কোম্পানি—ক্ষুদ্র কৃষক বা স্থানীয় বিশেষজ্ঞ নয়। কেনিয়ার কৃষিবিদ সেলেস্টিন ওতিয়েনো একে বলেছেন “খাদ্য দাসত্ব” এবং “উপনিবেশের দ্বিতীয় পর্যায়”।

স্বাস্থ্যখাতেও গেটস ফাউন্ডেশনের কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ, তারা রাজনীতি বা সামাজিক প্রেক্ষাপট উপেক্ষা করে কেবল প্রযুক্তি নির্ভর সমাধান দেয়। এতে স্বচ্ছতা ও স্থানীয় জবাবদিহির ঘাটতি রয়ে যায়।

রাজনৈতিক দার্শনিক গুইলিয়াম ডেভিড ব্লান্ট মনে করেন, গেটস ফাউন্ডেশনের মতো ‘ট্রান্সন্যাশনাল ফিলানথ্রপি’ ধনী ব্যক্তিদের অতিরিক্ত ক্ষমতা দেয়—যা স্থানীয় জনগণের স্বায়ত্তশাসনের পরিপন্থী।

ফলে গেটসের অনুদান আফ্রিকাকে অর্থনৈতিক নির্ভরতা ও পরনির্ভরতার ফাঁদে ফেলতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকা, ইথিওপিয়া, কেনিয়া ও নাইজেরিয়ার মতো দেশগুলো এখনও মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএইড-এর বরাদ্দ কমে যাওয়ার প্রভাব ভোগ করছে।

তবে সমস্যা কেবল গেটসের অনুদানে সীমাবদ্ধ নয়।

যত অর্থই ঢালা হোক, তা দিয়ে নেতৃত্বের অভাব, নৈতিক দুর্বলতা বা রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করা যাবে না। এই শূন্যতায় গেটসের মতো ব্যক্তি এগিয়ে আসেন, কিন্তু তাতে প্রকৃত সমস্যাগুলো আড়াল হয়।

১ জুন ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ গেটসকে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক Grand Order of Merit দেন। অথচ, ইথিওপিয়া এখনও দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক ব্যর্থতা ও অর্থের অপচয়ের সমস্যায় জর্জরিত।

আবির বিভাজনমূলক নীতিমালা ও যুদ্ধ উস্কে দেওয়ার ফলে ২০২০–২০২২ সালের গৃহযুদ্ধে ৬ লাখ মানুষ নিহত হয়। যুদ্ধ থামলেও তিগ্রে ও ওরোমিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘন এখনো বহাল। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন সত্ত্বেও আবি দাবি করেন, তাঁর বাহিনী কোনো যুদ্ধাপরাধ করেনি।

এই পরিস্থিতিতে আফ্রিকা যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তা হলো গভীর রাজনৈতিক সংস্কার—আরও অনুদান নয়। গেটসের অনুদান অনিচ্ছাকৃতভাবে সেই ক্ষমতা কাঠামোকেই টিকিয়ে রাখে, যা প্রকৃত উন্নয়নের পথে বাধা।

এই কারণে গ্রাসা মাশেলের উচ্ছ্বাস হতাশাজনক। তিনি চাইলে এই মুহূর্তে আফ্রিকার আসল সংকট—দুর্নীতিগ্রস্ত ও জবাবদিহিহীন নেতৃত্ব—নিয়ে কথা বলতে পারতেন। তার পরিবর্তে, বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতার আহ্বান আসলে ঔপনিবেশিক মানসিকতাকেই মজবুত করে।

হ্যাঁ, বিল গেটসের এই অনুদান প্রশংসনীয়। কিন্তু তিনি এমন এক দর্শনের ধারক—‘সাদা ত্রাণকর্তা’ ও ‘দাতাশ্রিত পুঁজিবাদ’—যা আফ্রিকার নিজস্ব সমস্যার সমাধান নয়।

কোনো বিদেশি ধনকুবের আফ্রিকাকে রক্ষা করতে পারবে না। শুধুমাত্র আফ্রিকার নিজস্ব নেতৃত্ব, স্বচ্ছতা, সাহস ও স্থানীয়ভাবে চালিত নীতিই পারে এই মহাদেশকে পরিবর্তন করতে।

আল জাজিরার থেকে অনুবাদ করা

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
X
LinkedIn