২০ মে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মাটির ঘর থেকে রাষ্ট্রপ্রধান : ‘বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট’ হোসে মুখিকা

সমাজকাল ডেস্ক

‘যারা কখনোই সন্তুষ্ট নয়, তারাই আসলে গরিব’ — হোসে মুখিকার দর্শন এখন ইতিহাস
বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে কিছু মানুষ থাকেন, যাঁদের গল্প বইয়ের পাতায় নয়, হৃদয়ে লেখা হয়। উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে আলবার্তো মুখিকা কর্দানো—বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট খ্যাত এই নেতা তেমনই একজন। ১৪ মে ২০২৫ তারিখে, ৮৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করলেন এই সাধারণ জীবনযাপনে অসাধারণ মানুষটি।

একজন বিপ্লবীর শুরু
হোসে মুখিকার জন্ম ১৯৩৫ সালের ২০ মে, মোন্তেভিদিও শহরের এক সাধারণ কৃষক পরিবারে। কৈশোরেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং ১৯৬০-এর দশকে গেরিলা সংগঠন ‘টুপামারোস’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হন। এই সংগঠনটি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে গোপন প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

চারবার বন্দি হন, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মৃত্যুর কাছাকাছি যান, আবার দুইবার পালানও। ১৯৭৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর তাকে ‘সবচেয়ে বিপজ্জনক’ বিপ্লবীদের একজন হিসেবে ১৪ বছরের কারাবাসে পাঠানো হয়, যার বড় অংশ ছিল অন্ধকার সেলে, মানসিক নিপীড়নের সঙ্গে।

কারাগার থেকে গণতন্ত্রের পথে
গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর মুখিকা রাজনীতির মূলধারায় প্রবেশ করেন। ২০০৫ সালে কৃষিমন্ত্রী হন এবং ২০১০ সালে, ৭৪ বছর বয়সে, উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এটাই ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে দৃশ্যমান অধ্যায়, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়—নিজের ভাষায়, “প্রেসিডেন্ট হওয়া জীবনের বড় প্রাপ্তি নয়, বরং কারাগার থেকে মুক্তির দিনটাই ছিল সবচেয়ে আনন্দের।”

এক অনন্য শাসকের চিত্র
হোসে মুখিকা বিশ্ব রাজনীতির এক বিরল চরিত্র। প্রেসিডেন্ট হয়েও রাজপ্রাসাদে না থেকে থাকতেন গ্রামীণ অঞ্চলের এক মাটির ঘরে। গায়ে সাধারণ পোশাক, পুরনো ১৯৮৭ সালের ভক্সওয়াগন বিটলে চড়ে চলাফেরা করতেন, নিজের বেতনের ৯০ ভাগ দান করতেন সমাজসেবায়।

তিনি আইন করে গর্ভপাত বৈধ করেন, সমলিঙ্গ বিবাহকে বৈধতা দেন এবং উরুগুয়েতে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে গাঁজার বাজার নিয়ন্ত্রণ চালু করেন—যা তাকে একদিকে সমালোচিত করলেও, অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচার, উদারনীতি ও মানবিকতার প্রতীকে পরিণত করে।

সমালোচনার পরও অনবদ্য জনপ্রিয়তা
যদিও শিক্ষা খাতে প্রতিশ্রুত সংস্কার বাস্তবায়ন ব্যর্থ হয়, এবং সরকারি ব্যয় বাড়ার কারণে কিছু সমালোচনা ছিল, তবে তার জনপ্রিয়তা ছিল ঈর্ষণীয়—একাধিক জরিপে ৭০ শতাংশের বেশি জনসমর্থন পেয়েছেন। মুখিকার সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল দুর্নীতিমুক্ত এবং মানবিক গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব, যেখানে নেতা জনতার সঙ্গে একাত্ম থাকেন।

শেষ সময় এবং দার্শনিক বিদায়
২০২৩ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঘোষণা দেন তিনি। এরপরের সময়গুলোতে মৃত্যু নিয়ে তার মন্তব্যগুলো হয়ে ওঠে আরও গভীর ও দার্শনিক। তার শেষ সাক্ষাৎকারে বলেন:

“মৃত্যু অনিবার্য। এটা বুঝেই জীবনকে উপভোগ করতে হয়। হয়তো মৃত্যু জীবনের লবণের মতোই—অপ্রিয়, কিন্তু প্রয়োজনীয়।”

উত্তরাধিকার ও চিরস্থায়ী প্রভাব
২০২০ সালে রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও তার রাজনৈতিক দলের প্রভাব কমেনি। ২০২৪ সালে তার রাজনৈতিক উত্তরসূরি ইয়ামান্দু অরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ‘ফ্রেন্তে আমপ্লিও’ পার্টি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।

মুখিকার রেখে যাওয়া বার্তাটি কেবল উরুগুয়েতে নয়, গোটা বিশ্বেই অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে—নেতৃত্ব মানেই ক্ষমতা নয়, ক্ষমতাকে মানুষ ও মানবতার সেবায় ব্যবহার করাই প্রকৃত নেতৃত্ব।

উদ্ধৃতি যা আজ ইতিহাস
“আমি দরিদ্র নই। দরিদ্র তারা, যারা চিরকাল আরও চায়, কিন্তু কখনও তৃপ্ত নয়।”