২ জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৮ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
Kaba

মসজিদে হারামের প্রথম নারী নিরাপত্তা কর্মী

মাইসারা জান্নাত :

মসজিদে হারামের প্রথম নারী নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান মোনা। সৌদি ডিফেন্সের নারী সদস্য তিনি।  ২০২১ সালে মসজিদে হারাম, মসজিদে নববীসহ ইসলামের বেশ কয়েকটি পবিত্র স্থানে ১২ জন নারী নিরাপত্তা কর্মীকে শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে মসজিদে হারামের শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করে মুসলিম বিশ্বে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন মোনা।

খাকি রঙের সামরিক পোশাক, কোমরের নিচ পর্যন্ত লম্বা জ্যাকেট এবং মাথার চুল ঢেকে দেওয়া ঘোমটার উপর কালো ব্যারেট পরে মোনা তার দায়িত্ব পালন করেন মক্কার মসজিদে হারামে ঘুরে ঘুরে। মোনার চোখে ছিল দৃঢ় প্রত্যয়, হৃদয়ে ছিল বাবার স্বপ্ন, আর হাতে ছিল দায়িত্বের ভার। যখন তিনি মক্কার মসজিদে হারামের পবিত্র চত্বরে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত হন, তখন কেবল একজন নারী সেনা সদস্য হিসেবে নয়, বরং সৌদি নারীদের এগিয়ে চলার প্রতীক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম লেখান।

মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীতে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা লাখ লাখ মানুষের ভিড় জমে প্রতিদিন। এদের মধ্যে বিপুল সংখ্যকই নারী, যারা ইবাদতের উদ্দেশে আসে, তাওয়াফ করে, নামাজ পড়ে এবং রওজা শরিফে সালাম পেশ করে। এত বিপুল নারী উপস্থিতির মাঝে তাদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও সম্মান রক্ষায় নারীদের জন্য নারী নিরাপত্তা কর্মী থাকা সময়ের দাবি। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, যেখানে একজন নারী নিরাপত্তা সদস্যের হস্তক্ষেপই হয় যথাযথ ও গ্রহণযোগ্য। তাই মোনার মতো নারীরা যখন মসজিদে হারামে দায়িত্ব পালন করেন, তখন তা কেবল একটি পেশাগত দায়িত্ব নয়, বরং তা নারী-পুরুষ সমানভাবে ধর্মীয় পরিবেশে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রতীক হয়ে উঠে। মোনা যেন ধর্মীয় পরিবেশে সেই সমতা ও মর্যাদার কণ্ঠস্বর, যিনি মসজিদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থেকে নারী উপস্থিতিকেও মর্যাদা দেন।

রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মোনা বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন সেনা সদস্য। আমি প্রয়াত বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করছি, তার কাজে পূর্ণতা দিতে চাই। আজ আমি দাঁড়িয়ে আছি মক্কার পবিত্র মসজিদে হারামে। মুসল্লিদের সেবা করা অত্যন্ত মহৎ এবং সম্মানজনক কাজ।’ তার কণ্ঠে ছিল আবেগ, ছিল আত্মবিশ্বাস, ছিল নতুন এক সৌদি নারীর গর্বিত উচ্চারণ।

২০১৮ সালের আগে এ দৃশ্য হয়তো কল্পনাও করা যেত না। অথচ এখন সেই কঠোর রক্ষণশীল সৌদি আরবেই নারীরা সেনাবাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন, পবিত্র হজের নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করছেন, এমনকি প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে গৃহীত ‘ভিশন ২০৩০’ নামক সংস্কার কর্মসূচি।

এই কর্মসূচির অধীনে নারীদের গাড়ি চালানোর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে এবং সরকারি চাকরি ও সেনাবাহিনীতেও প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এসব সংস্কারের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের একপেশে সমাজব্যবস্থায় নারীদের জন্য উন্মোচিত হয়েছে নতুন দিগন্ত।

মোনার মতোই আরেকজন নারী সেনা সদস্য সামার। তিনি বলেন, ‘মনোবিজ্ঞানে পড়াশোনার পর আমার পরিবার আমাকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে উৎসাহ দেয়। এটা আমার জন্য বিশাল একটি অর্জন। সবচেয়ে বড় গর্বের বিষয় হলো ধর্ম, দেশ এবং আল্লাহর মেহমানদের সেবা করতে পারা।’ সামারের কণ্ঠেও ছিল আত্মপ্রত্যয়, ছিল দেশের জন্য কিছু করে দেখানোর অনুপ্রেরণা।

এই নারীরা শুধু চাকরি করছেন না, তারা নতুন প্রজন্মের নারীদের সামনে সৃষ্টি করছেন সম্ভাবনার নতুন পথ। কেবল বাহ্যিক পোশাকে নয়, তাদের চিন্তাভাবনায়, ব্যক্তিত্বে ও দায়িত্ববোধে ফুটে উঠছে পরিবর্তিত এক সৌদি আরব, যেখানে নারীরা আর ঘরবন্দি থাকেন না, বরং দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন।

করোনা মহামারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে সৌদি সরকার সীমিত পরিসরে হজের কার্যক্রম চালু রাখে। ২০২১ সালে নারী সেনা সদস্যরা মক্কার মসজিদে হারামে স্বাস্থ্যবিধি মানা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ভিড় সামলানোর মতো কঠিন দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন। পবিত্র স্থানগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে তাদের ভূমিকা প্রশংসিত হয় দেশ-বিদেশে।

মোনার চোখে যেমন ছিল তার বাবার স্বপ্ন, তেমনিভাবে আজকের মেয়েদের চোখে থাকবে মোনার সেই সাহসী পথচলার গল্প। সৌদি নারীর অগ্রগতি আর মোনার প্রতিকৃতি তাই এখন শুধু সংবাদ নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে এক অনুপ্রেরণার প্রতীক, এক নিঃশব্দ বিপ্লবের জ্বলন্ত আলো।

-রয়টার্স অবলম্বনে

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
X
LinkedIn