১ জুন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
Pelistane

গাজার ধ্বংসস্তূপে তরুণীর বেঁচে থাকার গল্প

ইমান আবু জায়েদ:

যুদ্ধ শুরুর আগে আমার জীবন ছিল সাধারণ। গাজার অনেক তরুণীর মতো আমার মাঝেও বাস করত উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর উদ্বেগের এক মিশ্র অনুভূতি। আমার স্বপ্ন ছিল ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক সম্পন্ন করে লেখক হওয়ার। আর ভয় ছিল গাজার ক্রমাগত হামলা ও অস্থিরতা হয়তো আমার শিক্ষা ও লেখক হওয়ার পথ রুদ্ধ করে দেবে।

আমি কখনো কল্পনাও করিনি যে, আমার দৈনন্দিন জীবনের রুটিন, ঘরবাড়ি, বিশ্ববিদ্যালয়, বন্ধুবান্ধবসহ সবকিছু হারিয়ে যাবে। আর আমাকে লড়াই করতে হবে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য। যুদ্ধ শুরু হলে আমরা ভাবলাম, হয়তো এটা কেবল আরেকটি সংক্ষিপ্ত লড়াই, যেমনটা গাজায় প্রায়ই হয়। কিন্তু পরে ব্যাপারটা ভিন্ন মনে হলো। এবারের বিস্ফোরণ ছিল খুবই প্রবল ও দীর্ঘস্থায়ী। খুব দ্রুতই বুঝতে পারলাম, এই দুঃস্বপ্ন থামবে না। বরং আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে।

২০২৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর আমরা প্রথম নিজেদের স্থান ত্যাগের নির্দেশনা পাই। ভাবারও সময় ছিল না। আমরা কিছু সামান্য জিনিস গোছাতে শুরু করতেই বোমার শব্দ আরও জোরালো হয়ে উঠল। আমাদের ভবনের ওপরের তলা লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছিল। আমরা হন্তদন্ত হয়ে ভবন ছেড়ে পালাই। সঙ্গে ছিল কেবল একটি ছোট ব্যাগ। আমার বাবা হুইলচেয়ারে আমার দাদিকে ঠেলছিলেন, আর আমি আমার ছোট ভাইয়ের হাত ধরে দৌড়াচ্ছিলাম। জানতাম না কোথায় যাচ্ছি। আমাদের মহল্লা সেদিন কেয়ামতের দিনের বিভীষিকাময় দৃশ্যের মতো হয়ে উঠেছিল। মানুষ দৌড়াচ্ছে, চিৎকার করছে, কাঁদছে আর বেঁচে যাওয়া জীবনটা আঁকড়ে ধরে আছে।

রাত নেমে এলে আমরা এক আত্মীয়ের বাড়িতে অস্থায়ী আশ্রয় নিই। সেখানে ষোলোজন মানুষ আঁটসাঁট হয়ে একটি ঘরে রাত কাটাই। বিন্দুমাত্র গোপনীয়তা ও আরামের সুযোগ ছিল না। সকালে আমরা কঠিন সিদ্ধান্ত নিই, ‘মানবিক এলাকা’ ঘোষিত কোনো এক শরণার্থী শিবিরে চলে যাব। তখন আমাদের হাতে কিছুই ছিল না। পানি সংকট, খাবার সংকট, প্রচণ্ড শীত, অল্প কয়টি কম্বল দিয়ে কাটাতে হতো দিনরাত। আদিম কায়দায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আর রান্নার কাজ চলত। আগুন জ্বালিয়ে খাবার তৈরি করতাম, যেন পাথরের যুগে ফিরে গেছি।

এ অবস্থার মধ্যেই খবর এলো আমাদের বাড়ি বোমায় ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। চুপ করে বসে কাঁদছিলাম। এই ট্র্যাজেডি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমাদের বাড়ির নিচ তলায় ছিল বাবার স্বর্ণালংকারের দোকান। তাই ভবনটি ধ্বংস হওয়ার মানে শুধু ছাদ-দেয়াল হারানো নয়, বরং জীবনের সব সম্বল, সবকিছু হারানো।

আমাদের দিনগুলো ছিল কষ্ট আর অভাবের চাদরে মোড়ানো। আমি বেশিরভাগ বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলি। যাদের কণ্ঠস্বর এক সময় আমার দিনগুলোকে উষ্ণ করে তুলত, তারা হারিয়ে গেল। মাঝে মাঝে ইন্টারনেটে ঢোকার সুযোগ পেলে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু রামার খোঁজ নিতাম। সে তখন উত্তর গাজায় ছিল। ২০২৪ সালের ১৫ জানুয়ারি আমার বন্ধু রাওয়ান আমাকে একটি বার্তা পাঠায়। তখন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় সেটি আমার কাছে পৌঁছাতে কয়েকদিন লেগে যায়। বার্তাটি ছোট ছিল, কিন্তু তা আমাকে চুরমার করে দিয়েছিল, ‘রামা শহীদ হয়েছে’।

বিশ্ববিদ্যালয়ে রামা আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বার্তাটি বারবার পড়ছিলাম, যেন তাতে অন্য কিছু খুঁজে পাই, যেন বার্তাটি মিথ্যা হয়ে যায়। কিন্তু এ নিঃশব্দ সত্য বড়ই নির্দয় ও নির্মম! আমি তাকে বিদায় জানাতে পারিনি। তার শেষ কথা শুনতে পারিনি, তার হাত ধরতে পারিনি, একবারও বলতে পারিনি, ‘আমি তোমায় ভালোবাসি।’ মনে হচ্ছিল, আমি নিঃশ্বাস নিচ্ছি, কিন্তু আমার ভিতরে আত্মা নেই।

এই শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আরও এক হৃদয় বিদারক খবর পেলাম। ২০২৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি আমার বাবার সব চাচাত ভাই, তাদের স্ত্রী-সন্তানসহ পুরো পরিবার শহীদ হয়েছেন। তখন আমি দেখেছি, আমার বাবা কি ভয়ংকরভাবে ভেঙে পড়েছেন! এমন ভাঙন আমি আগে কখনো দেখিনি। তার শোক ছিল এত গভীর, যা ভাষায় প্রকাশ কারার মতো নয়।

২০২৪ সালের ৮ জুন আমরা একটি তাঁবু থেকে উঠে নতুন ভাড়া নেওয়া অ্যাপার্টমেন্টে উঠি, জীবনটা আবার শুরু করার ইচ্ছা নিয়ে। ঠিক তখনই ইসরায়েলি সেনারা এলাকা ঘিরে ফেলে। আমি প্রথম দেখি, একটি ট্যাঙ্ক ধীরে ধীরে রাস্তায় এগিয়ে আসছে। আতংকে আমি বাবার দিকে ছুটে যাই, চিৎকার করে তাকে ডাকি। কিন্তু তার কাছে পৌঁছানোর আগেই একটি ক্ষেপণাস্ত্র আমাদের ভবনে আঘাত করে। ধোঁয়া আর ধুলায় ঢেকে যায় সব। আমি বুঝতেই পারছিলাম না, আমি বেঁচে আছি কি না। কালিমায়ে শাহাদাত পাঠ করার চেষ্টা করি, আল্লাহর কৃপায় তা করতে পারি। তারপর শুরু করি চিৎকার। বাবাকে খুঁজতে থাকি। দূর থেকে তার কণ্ঠস্বর শুনি। তিনি বলছেন, ‘বাইরে যেও না, ড্রোন এখনো বোমা ফেলছে।’

আমি কয়েক কদম হাঁটতেই অজ্ঞান হয়ে যাই। মনে আছে, আমাকে ভবন থেকে নামিয়ে এনে একটা কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল। আমি রক্তাক্ত ছিলাম। মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরে আসত, আবার অজ্ঞান হয়ে যেতাম। তখন অ্যাম্বুলেন্স আমাদের বাসার রাস্তায় পৌঁছতে পারেনি। কারণ ট্যাঙ্ক রাস্তায় অবস্থান করছিল। আমার মা, বোন এবং আমার দুই ঘণ্টা ধরে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। পরে এলাকার কিছু তরুণ কৌশলে আমাদের বের করে আনেন। তারা আমাকে কম্বলে মুড়ে অ্যাম্বুলেন্সে তোলেন। রাস্তাতেই চিকিৎসকরা আমার ক্ষত বাঁধতে শুরু করেন সবার চোখের সামনেই। পুরো সময়টা আমি শুনছিলাম তারা যা বলছিলেন। তারা বলছিলেন, আমি জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে আছি। আমি শুনতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু কথা বলতে পারছিলাম না। হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারি, আমার মাথা, হাত, পা ও পিঠে গুরুতর আঘাত লেগেছে। ব্যথা ছিল অসহনীয়। মায়ের অনুপস্থিতি ভয় বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমাকে জরুরি অস্ত্রোপচারে নেওয়া হয়েছিল।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আমাকে নিয়মিত ড্রেসিং করাতে হতো। প্রতিবারের যন্ত্রণা ছিল অসহ্য। রক্ত দেখলেই আমার দম বন্ধের উপক্রম হতো। বাবা আমাকে প্রতিবার নিয়ে যেতেন এবং সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন, ‘আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দেবেন মা। আমরা ঠিকই পার হয়ে যাব।’ শারীরিক ও মানসিকভাবে আমি গভীর বিষণ্নতায় ডুবে যাই। মনে হতো, আমি ডুবে যাচ্ছি এক অন্তহীন বেদনা, ভয় আর ক্লান্তির স্রোতে। জানতাম না কীভাবে নিঃশ্বাস নিতে হয়, কীভাবে এগিয়ে যেতে হয়, এমনকি কেন বেঁচে আছি।

আমাদের মাথার ওপর ছাদ ছিল না। খাদ্য সংগ্রহ ছিল প্রতিদিনের সংগ্রাম। যাদের হারিয়েছি, তাদের শোকের দহনে দগ্ধ হতাম প্রতিনিয়ত। আর এই ভয় ছিল, যেকোনো সময় আমরাও মারা যেতে পারি। মনে হচ্ছিল, সবকিছুই চিৎকার করে বলছে, আর পারব না। তবু এই অন্ধকারের মধ্যে আমি বেঁচে থাকলাম দিনের পর দিন। ব্যথায় ছিলাম, কিন্তু বেঁচে ছিলাম।

নিজে নিজে আবার পড়াশোনা শুরু করি। যখন আমার বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন ক্লাস চালু করে তখন তাতে যুক্ত হই। আমার হাত তখনো ভাঙা, প্লাস্টারে বাঁধা, ঠিকভাবে ব্যবহারই করতে পারছিলাম না। মা সাহায্য করতেন, শিক্ষদের লেকচার তিনি লিখে দিতেন। আমার শিক্ষকরা আমার অবস্থা বুঝতেন, যতটা পারতেন সাহায্য করতেন। কিন্তু সমস্যা ছিল অনেক। বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট পেতে কষ্ট হতো। কখনো পরীক্ষার সময় বিদ্যুৎ চলে গেলে বা নেটওয়ার্ক না থাকলে পরীক্ষা মিস করতাম। পরে আবার তা দিতে হতো। তবুও আমি এগিয়ে চলেছি। ধীরে ধীরে আমার শারীরিক অবস্থারও উন্নতি হয়েছে। আজও আমরা তাঁবুতে বাস করছি। খাবার ও পানির অভাবে কষ্টে দিন কাটছে আমাদের। গাজার সকলের মতো আমরাও দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি।

আমি ধ্বংসস্তূপের ভেতরেও পথ খুঁজে পেয়েছি, যন্ত্রণার মাঝেও আশা খুঁজে পেয়েছি, আর হারানোর মাঝেও খুঁজে পেয়েছি লেখার, সাক্ষ্য দেওয়ার এবং প্রতিরোধ করার উপকরণ। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি বেঁচে থাকব। আমি ভালোবাসব, স্বপ্ন দেখব এবং কথা বলব। কারণ খুব সহজ ভাষায় বললে, আমিও বেঁচে থাকার যোগ্য, যেমন পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ বেঁচে থাকে।

আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর : মাইসারা জান্নাত

লেখক : শিক্ষার্থী, গাজা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
X
LinkedIn