২ জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৮ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
আল জাজিরা থেকে সংগৃহীত

কে ছিলেন সানা ইউসুফ, পাকিস্তানি টিকটক তারকা গুলিতে নিহত হলেন?

 

 

কে ছিলেন সানা ইউসুফ? পাকিস্তানি টিকটক তারকা যিনি গুলিতে নিহত হলেন? তাকে নিয়ে অঅজকের আয়োজন।

 

সারাহ শামিম : 

 

পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে ১৭ বছর বয়সী সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার সানা ইউসুফকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

 

সানা ইউসুফ, যিনি টিকটক ও ইনস্টাগ্রামে লাখো অনুসারীর মালিক ছিলেন, সোমবার নিজ বাড়িতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। এটি পাকিস্তানে নারীর প্রতি সহিংসতার সাম্প্রতিক একটি নজিরবিহীন উদাহরণ।

 

কী ঘটেছিল সানা ইউসুফের সঙ্গে?

স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, ইসলামাবাদে বিকেল ৫টার দিকে (জিএমটি ১২:০০) সানা ইউসুফকে গুলি করা হয়। তার মা ফারজানা ইউসুফের দায়ের করা এফআইআরের বরাতে ‘ডন’ জানায়, ইউসুফকে বুকে দুটি গুলি করা হয়। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলেও তার মৃত্যু হয়।

 

কে ছিলেন সানা ইউসুফ?

চিত্রাল থেকে আসা এই তরুণী ছিলেন একজন সোশ্যাল মিডিয়া তারকা। বুধবার পর্যন্ত তার টিকটকে অনুসারীর সংখ্যা ছিল ১১ লাখ। তিনি গান গেয়ে লিপ-সিঙ্ক ভিডিও পোস্ট করতেন। সর্বশেষ ভিডিওটি ছিল তার জন্মদিন উদযাপনের মুহূর্তের কোলাজ।

 

মঙ্গলবার (৩ জুন) তাকে চিত্রালের চুইঞ্জ গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

 

হত্যাকারী সম্পর্কে কী জানা গেছে?

ইসলামাবাদের ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ (আইজিপি) সৈয়দ আলি নাসির রিজভী মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ২২ বছর বয়সী বেকার অভিযুক্তকে ফয়সালাবাদ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যা ইসলামাবাদ থেকে প্রায় ৩২০ কিমি দক্ষিণে অবস্থিত।

 

রিজভী বলেন, “অভিযুক্ত বারবার সানার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল। সাড়া না পেয়ে সে তাকে গুলি করে হত্যা করে।” তিনি আরও জানান, অভিযুক্ত সানার ফোন নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তবে পুলিশ ফোন এবং হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র জব্দ করেছে।

 

‘ডন’কে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, অভিযুক্ত ও সানার পরিচয় ছিল প্রায় এক বছর ধরে। অভিযুক্ত মে ২৮-২৯ তারিখে ইসলামাবাদে গিয়েছিল সানাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে, কিন্তু তারা দেখা করতে পারেনি। পরে ফোনে কথা বলে ২ জুন সাক্ষাৎ করতে চায়। কিন্তু সানা বাড়ির বাইরে না আসায় অভিযুক্ত জোরপূর্বক ঢুকে পড়ে এবং বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।

 

হত্যাকালে সানার বাবা-মা বাসায় ছিলেন না, তবে তার খালা উপস্থিত ছিলেন।

 

সানার হত্যাকাণ্ডে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে?

নারী ও শিশুদের অধিকার রক্ষায় গঠিত ন্যাশনাল কমিশন অন দ্য স্ট্যাটাস অব উইমেন এ ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত দাবি করেছে। তাদের চেয়ারপারসন উমে লায়লা আজহার বলেন:

 

“এই মামলাকে সমাজের লজ্জা, সম্মানের মিথ বা আইনি ফাঁকফোকরের আড়ালে হারিয়ে যেতে দেওয়া হবে না। নিজের বাড়িতেও নারীরা নিরাপদ নয়—সানার মৃত্যু তার প্রমাণ। আমরা বিচারের দাবি জানাচ্ছি।”

 

পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নাকভি এক্স-এ পোস্ট করে অভিযুক্তের গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, “অস্ত্র এবং নিহতের আইফোন উদ্ধার করা হয়েছে, এবং অভিযুক্ত হত্যার কথা স্বীকার করেছে।”

 

সামাজিক প্রতিক্রিয়া

নারী অধিকার সংগঠন অরাত মার্চ লিখেছে:

 

“সানা কেবল একজন কিশোরী ও টিকটকারই নন, তিনি ছিলেন পিতৃতন্ত্রের সহিংসতার শিকার। নারীরা যখন প্রকাশ্যে নিজেদের জায়গা তৈরি করে, তখন এই সমাজ তাদের থামাতে হিংস্র হয়ে ওঠে।”

 

অভিনেত্রী মাহিরা খান ইনস্টাগ্রামে সানার মৃত্যুর খবরে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লিখেছেন—“Disgusted to the core”।

 

পাকিস্তানে এমন ঘটনার প্রেক্ষাপট

সানা ইউসুফের হত্যাকাণ্ড অনাকাঙ্ক্ষিত নয়। গত কয়েক বছরে পাকিস্তানে বহু তরুণী পরিচিত পুরুষদের দ্বারা হত্যা হয়েছেন, বিশেষ করে তারা যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় থাকেন।

 

ডিজিটাল রাইটস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নিঘাত দাদ বলেন:

 

“এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এটি এক ধারাবাহিক সহিংসতার অংশ, যেখানে নারীর আত্মনির্ভরতা ও দৃশ্যমানতাই তাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একটি ‘না’ পুরুষতান্ত্রিক অহংকে আহত করে এবং তা রূপ নেয় সহিংসতায়।”

 

২০২৪ সালে পাকিস্তানে তথাকথিত “সম্মান রক্ষায়” ৩৪৬ নারীকে হত্যা করা হয়, যা আগের বছরের চেয়ে বেশি। তবে সানার মতো অনেক হত্যাকাণ্ড এই পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না, কারণ এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে থাকে প্রত্যাখ্যাত প্রেমিক কিংবা পরিচিত পুরুষ।

 

উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে রয়েছে—

 

২০২১ সালে ইসলামাবাদে নূর মুখাদ্দাম-এর হত্যা। অভিযুক্ত জাহির জাফরকে ২০২২ সালে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্ট এ রায় বহাল রাখে।

 

২০১৬ সালে ভাইয়ের হাতে নিহত কান্দিল বালোচ।

 

২০২২ সালে শিকাগোতে টিকটক পোস্টের কারণে সাবেক স্বামীর গুলিতে নিহত সানিয়া খান।

 

নিঘাত দাদ বলেন, “অনলাইন হেনস্তা, নারীর দৃশ্যমানতা, এবং শারীরিক সহিংসতা—এই সব একে অন্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাষ্ট্রকে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।”

 

সারাংশে, সানা ইউসুফের নির্মম হত্যাকাণ্ড পাকিস্তানের নারীদের প্রতি সহিংসতার একটি প্রতীকী ও উদ্বেগজনক চিত্র। সমাজ ও রাষ্ট্র—দুইয়েরই জবাবদিহি প্রয়োজন।

 

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আলজাজিরার বিশ্লেষন

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
X
LinkedIn