২১ নভেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কালাজ্বর কেনো হয়? এর উপসর্গ ও চিকিৎসা

জীবনধারা ডেস্ক:

কালাজ্বর, যাকে ইংরেজিতে‘ইয়েলো ফিভার’ বলে। এটি পরজীবীর সংক্রমণজনিত একটি দীর্ঘস্থায়ী ও প্রাণঘাতী রোগ, যা বেলেমাছির কামড়ের সাহায্যে বিস্তার লাভ করে। এ রোগের জীবাণু শরীরে প্রবেশের পর ২ থেকে ৬ মাসের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পায়। সময়মতো এবং সঠিক চিকিৎসা না হলে কালাজ্বরে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

কিন্তু কি এই কালাজ্বর? এর লক্ষণ বা উপসর্গ কি? এর চিকিৎসা কি ও কোথায় পাওয়া যায়? -এসব বিষয়ে সমাজকালকে বলেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সহকারী পরিচালক ও জাতীয় কালাজ্বর নির্মূল কর্মসূচীর প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. এম এম আক্তারুজ্জামান।

কালাজ্বর কি:

ডা. এম এম আক্তারুজ্জামান জানান, কালাজ্বর ভিসেরাল লিশম্যানিয়াসিস বা লিশম্যানিয়া ডোনোভানি নামক এককোষী প্রোটোজোয়া পরজীবীর সংক্রমণজনিত একটি রোগ। লিশম্যানিয়াসিস রোগের কয়েকটি ধরণ রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর রোগ কালাজ্বর। এর জীবাণু প্রথমে মানুষের শরীরের রক্তের ম্যাক্রোফেই দ্বারা বাহিত হয়ে অন্ত্রে প্রবেশ করে এবং পরে তা লিভার, প্লীহা ও অস্থিমজ্জাকে আক্রান্ত করে বংশ বৃদ্ধি করে।

সাধারণত স্ত্রী স্যান্ডফ্লাই বা বেলেমাছির কামড়ের মাধ্যমে সংক্রমিত হয় কালাজ্বর। সময়মত চিকিৎসা না হলে প্রায় ৯৫ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হয়। কেবলমাত্র স্ত্রী বেলে মাছিই এ রোগ ছড়িয়ে থাকে। ডিম পরিপক্ব করার জন্য পশু, পাখী এবং মানুষের রক্ত গ্রহণ করে থাকে সে।

বেলে মাছি সাধারণত ঘর ও এর আশপাশের ফাটলে, স্যাঁতস্যাঁতে ও আর্দ্র মেঝেতে, দেয়াল, কাঠের আসবাবপত্রের ফাটল, উইপোকার গর্ত বা আশপাশের ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকে। ভোঁর থেকে সন্ধ্যার মধ্যে বেশি কামড়ে থাকে এই মাছি।

কালাজ্বরের অপর নাম দমদম জ্বর:

১৯০১ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক লিশম্যান উত্তর কলকাতার দমদমে এক রোগাক্রান্ত ব্যক্তির দেহ থেকে প্রথম এই রোগের এককোষী প্রটোজোয়া পরজীবীর সন্ধান পান। জীবাণুটি সর্বপ্রথম দমদম অঞ্চলে শনাক্ত করা হয়েছিল বলে কালাজ্বরকে স্থানীয়ভাবে দমদম জ্বরও বলে।

এর লক্ষণ বা উপসর্গ কি:

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, এই জ্বরের প্রধান লক্ষণগুলো হলো – অনিয়মিত দীর্ঘমেয়াদী জ্বর, প্লীহা এবং যকৃতের বৃদ্ধি, ওজন হ্রাস এবং রক্ত স্বল্পতা। বিশ্বব্যাপী কালাজ্বর একটি নেগলেক্টেড ট্রপিক্যাল ডিজিজ বা এনটিডি রোগ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। সাধারণত গ্রামীণ এলাকাগুলোতে কালা জ্বর একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা।

কালাজ্বরের জীবাণু শরীরে প্রবেশের পর সাধারণত ২মাস থেকে ৬মাসের মধ্যে এর লক্ষণ প্রকাশ পায়। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না পেলে কালাজ্বরে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এই রোগের লক্ষণসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বিষণ্ণতা বা অবসাদ, জ্বর, ওজন হ্রাস পাওয়া, শরীরে ক্ষত হওয়া, চামড়া কালচে হয়ে যাওয়া, কলিজা ও প্লীহার আকার বড় হয়ে যাওয়া এবং রক্তস্বল্পতা ইত্যাদি।

কালাজ্বরের চিকিৎসা:

ম্যালেরিয়ার পরই পরজীবীর সংক্রমণজনিত রোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী রোগ কালাজ্বর। এই জ্বরের কোন প্রতিষেধক নেই। কালাজ্বর হয়েছে সন্দেহ হলে প্রথমেই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোগ শনাক্ত করতে হবে। এরপর তাঁর পরামর্শ ও নির্দেশনা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে ওষুধ খেতে হবে।

এ রোগের চিকিৎসায় বর্তমানে বাংলাদেশে সর্বাধিক ব্যবহৃত হচ্ছে মুখে খাওয়ার ক্যাপসুল মিল্টেফোসিন, যা সরকারিভাবে বিনামূল্যে দেওয়া হয়। এছাড়াও সোডিয়াম এন্টিমনি গ্লুকোনেট (যা খুব অল্প ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়) এবং অ্যামফোটেরিসিন বি ডিঅক্সিকোলেট- নামের দুটি ওষুধও ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে যেকোনো ওষুধ খাওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে, অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, অন্তঃসত্ত্বা নারী, বিবাহিত নারী যারা নিয়মিত গর্ভনিরোধ ওষুধ গ্রহণ করেন না কিংবা অধিক রক্তশূন্যতায় ভোগেন বা যে মায়েরা বাচ্চাকে দুধ পান করায়, দুই বছরের নিচের শিশু, যক্ষ্মা, এইডস বা অন্য কোন জটিল রোগসহ কালাজ্বরের রোগীদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

বিনামূল্যে মিলছে চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয়:

ডা. এম এম আক্তারুজ্জামান জানান, কালাজ্বর মুক্ত অবস্থা অর্জন করতে দেশের কালাজ্বর উপদ্রুত এলাকায় সকল উপজেলায় বিনামূল্যে কালাজ্বর রোগ সনাক্ত করা হয় ও ২৯টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

এর মধ্যে সাতটি রেফারেল হাসপাতালেও উন্নত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এগুলো হলো- ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ময়মনসিংহের সূর্যকান্ত কালাজ্বর গবেষণা কেন্দ্র।

সর্বশেষ রোগটি দ্রুত ও নির্ভূলভাবে সনাক্ত করতে ও উন্নত চিকিৎসা দিতে বিশেষায়িত কেন্দ্র হিসেবে মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে কালাজ্বরের ‘সেন্টার অফ এক্সিলেন্স’ (সিওই) স্থাপন করা হয়েছে।