বিশেষ প্রতিবেদক :
🌩️ বজ্রপাতে মৃত্যু: শীর্ষে হাওরের মানুষ, সবচেয়ে ঝুঁকিতে কৃষক
বাংলাদেশে বজ্রপাত এখন আর শুধু প্রকৃতির ভয়াল রূপ নয়, এটি এক ভয়াবহ প্রাণঘাতী দুর্যোগ। বিশেষ করে হাওড় অঞ্চলের কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষদের জন্য এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়ে উঠেছে মৃত্যুর ফাঁদ।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৩০০ জন মানুষ বজ্রপাতে মারা যান, যাদের অধিকাংশই কৃষক, জেলে বা নিম্নআয়ের দিনমজুর। ডিজাস্টার ফোরাম নামক বেসরকারি সংগঠনের হিসাবে ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বজ্রপাতে মারা গেছেন ৪ হাজার ১৫৮ জন।
🌾 হাওরে ধান কাটার সময়েই মৃত্যুর মিছিল
বজ্রপাতজনিত মৃত্যু এপ্রিল-মে মাসে সবচেয়ে বেশি ঘটে—এ সময়েই হাওড় অঞ্চলে ধান কাটার ব্যস্ততা চলে। খোলা ও বৃক্ষহীন প্রান্তরে থাকা কৃষকরা বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন।
২০২৪ সালে বজ্রপাতে মারা গেছেন ২৮৮ জন, তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই কৃষক। চলতি বছরের এপ্রিলেই ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে একদিনে।
🧪বাংলাদেশে বজ্রপাত বৃদ্ধির পেছনে বায়ুদূষণ: একটি বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা
বাংলাদেশে প্রাক-বর্ষা মৌসুমে (এপ্রিল-মে) বজ্রপাতের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এ প্রবণতার সঙ্গে বায়ুদূষণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে। ‘রোল অব পলিউট্যান্টস অন দ্য বাইমোডাল লাইটনিং ডিস্ট্রিবিউশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাটি ২০২৫ সালের ১৮ এপ্রিল স্প্রিঞ্জার ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশিং কর্তৃক কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে খ্যাতনামা সাময়িকী ‘আর্থ সিস্টেমস অ্যান্ড এরভায়রনমেন্ট’
গবেষণাটির নেতৃত্ব দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আশরাফ দেওয়ান। গবেষণা দলে আরও রয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এ টি এম এস আজম, নাসরিন আক্তার, এম রাফিউদ্দিন, এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওকলাহোমার মোহাম্মদ আল-মাসুম মোল্লা।
গবেষণায় দেখা গেছে, এপ্রিল থেকে মে মাসে ভারত ও পাকিস্তানের দিক থেকে প্রবাহিত শক্তিশালী পশ্চিমা বাতাসের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রচুর ধূলিকণা ও সালফেট আসে। এ উপাদানগুলো মেঘের গঠন প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলে এবং বজ্রপাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে। ফলে এই সময়টিকে বজ্রপাতের ‘প্রথম বা শীর্ষ শিখর’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আবার আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে বজ্রপাতের ‘দ্বিতীয় শিখর’ দেখা যায়।
অন্যদিকে শীতকালে (ডিসেম্বর-জানুয়ারি) বায়ুমণ্ডলে সূর্যালোক কম পৌঁছানোর কারণে বজ্রপাতের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। কারণ শীতকালে বাতাসে পিএম ২.৫ (অতিক্ষুদ্র ধূলিকণা) এর ঘনত্ব বেড়ে সূর্যরশ্মি বাধাগ্রস্ত হয়, যা বজ্রপাতের জন্য প্রয়োজনীয় উত্তাপ ও আর্দ্রতা কমিয়ে দেয়।
গবেষকরা বলছেন, অ্যারোসল (যেমন ধূলিকণা, কালো কার্বন, পিএম ২.৫ ইত্যাদি) মেঘের ফোঁটার আকার ছোট করে দেয়, যার ফলে মেঘে বৈদ্যুতিক চার্জের বণ্টন পরিবর্তিত হয় এবং বজ্রপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এর ফলে বজ্রপাত ও বায়ুদূষণের মধ্যে একটি জটিল পারস্পরিক চক্র গড়ে ওঠে, যা শুধু বজ্রপাত নয়—জলবায়ু পরিবর্তন ও বায়ুমণ্ডলের রাসায়নিক গঠনেও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে।
অধ্যাপক আশরাফ দেওয়ান বলেন, “আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি, বায়ুদূষণ বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে বিশেষ করে প্রাক-বর্ষা মৌসুমে বজ্রপাতের ঘটনা বাড়ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে জৈব-জ্বালানি পোড়ানো নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।”
গুরুত্ব
গবেষণাটির ফলাফল বজ্রপাতের পূর্বাভাস ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কৃষি নিরাপত্তা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইফতি খায়রুল আমিন বলেন, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তন ও বায়ুদূষণ মিলেই বজ্রপাত বেড়ে যাচ্ছে।’
সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, অ্যারোসল, ধূলিকণা ও সালফেট বজ্রপাত বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৬ সালের একদিনে (৫ এপ্রিল) ৮ লাখ বজ্রপাতের ঘটনা রেকর্ড হয়!
এই গবেষণায় অংশ নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আশরাফ দেওয়ান ও বুয়েট, ইউনিভার্সিটি অব ওকলাহোমার গবেষকরা। তাঁদের মতে, বায়ুদূষণ, বিশেষ করে পিএম ২.৫, বজ্রপাত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
🛑 কার্যকর উদ্যোগ নেই, অর্থ অপচয়ই বাস্তবতা?
২০১৫ সালে বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘোষণা করা হলেও জনসচেতনতা বা প্রতিরোধমূলক প্রকল্পে অগ্রগতি নেই। সরকার দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে, যেখানে তালগাছ লাগানো, লাইটেনিং ডিটেকটর ও অ্যারেস্টার স্থাপন অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে বাস্তবে তা মাঠ পর্যায়ে কার্যকর হয়নি।
দুর্যোগ বিশ্লেষক গওহার নঈম ওয়ারা বলছেন, ‘‘বজ্রপাত রোধে আলাদা তহবিল নেই। আহতরা উপেক্ষিত, অনেকে আর স্বাভাবিক জীবনেও ফিরতে পারেন না।তিনি বলেনম বজ্রপাতে নিহত ব্যক্তির চেয়ে আহতদের সংখ্যা কমপক্ষে তিনগুন। বেঁচে থাকলেও তারা স্বাভাবিক কাজে ফিরতে পারে না।
📣 এখনই সময়: সমন্বিত উদ্যোগের
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কমাতে হলে এখনই আঞ্চলিক আশ্রয়কেন্দ্র, গোষ্ঠীগত সচেতনতা, হাওড় কৃষকদের জন্য ডিজিটাল বার্তা ব্যবস্থাপনা এবং বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে আন্তঃদেশীয় নীতিনির্ধারণ অত্যাবশ্যক।
বাংলাদেশ বাঁচাতে হলে আকাশের আগুন ঠেকাতে হবে—এই লড়াই এখনই শুরু করতে হবে।
⚠️ কিভাবে বাঁচবেন বজ্রপাত থেকে?
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও সতর্কতা:
✅ বজ্রপাতের সময় ঘরে অবস্থান করুন
✅ জানালা-দরজা বন্ধ রাখুন
✅ খোলা মাঠ, গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি বা ধাতব বস্তু এড়িয়ে চলুন
✅ রাবারের জুতা পরা উপকারী
✅ ৩০-৩০ নিয়ম: বজ্রের আলো ও শব্দের মাঝে সময় ৩০ সেকেন্ড বা কম হলে নিরাপদ আশ্রয়ে যান
✅ শিশুদের মাঠে খেলাধুলা বন্ধ রাখতে হবে
✅ বৈদ্যুতিক ডিভাইসের সংযোগ আগেই বিচ্ছিন্ন করুন
✅ জলাশয় থেকে দূরে থাকুন
🔔 আজকের সতর্কবার্তা (১২ মে ২০২৫)
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী আজ সোমবার ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম, রংপুরসহ ২০টি জেলায় বজ্রবৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতি ঘণ্টায় ৪৫-৬০ কিমি বেগে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।