১৫ মে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সাগরের বুকে কাতারের ইসলামি মিউজিয়াম

মাইসারা জান্নাত :

কাতারের রাজধানী দোহা। দোহা উপসাগরের দক্ষিণ তীরে নীল জলরাশির বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কাতারের ইসলামিক আর্ট মিউজিয়াম। এটাকে শুধু মিউজিয়াম বা জাদুঘর বলা ভুল হবে। বরং বলা যায়, মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক অক্ষয় আলয়, যেখানে অতীতের শিল্পচেতনা আর আধুনিক স্থাপত্যের মেলবন্ধনে গড়ে উঠেছে ইতিহাসের স্পর্শমাখা এক নিদর্শন। বিশাল এই জাদুঘরটি বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক ইসলামি জাদুঘর হিসেবে পরিচিত। বছরে পাঁচ লাখেরও বেশি দর্শনার্থী জাদুঘরটি পরিদর্শন করেন। এতে রয়েছে সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা।
দৃষ্টিনন্দন এই জাদুঘরটির নকশা করেছেন বিখ্যাত চীনা-মার্কিন স্থপতি আই. এম. পেই। ৯১ বছর বয়সে স্থপতি পেই নিজের অবসর ভেঙে ছয় মাস ভ্রমণ করেছিলেন মুসলিম বিশ্বের নানা প্রান্তে। খুঁজে ফিরেছেন ইসলামি সৌন্দর্যের উৎস। মিশরের প্রাচীন ইবনে তুলুন মসজিদ তাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিল। সেখান থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই তিনি তৈরি করেন ইসলামিক আর্ট মিউজিয়ামের কাঠামো।
২০০৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ইসলামিক আর্ট মিউজিয়াম। এটি নির্মিত হয়েছে একটি কৃত্রিম দ্বীপের ওপর, যার একদিকে ধৌ নৌকার নোঙরস্থান আর অপরদিকে সবুজ পার্কের মনোরম পরিবেশ। মূল ভবনের পাঁচতলা, একটি গম্বুজ এবং কেন্দ্রীয় টাওয়ার নিয়ে তৈরি এই স্থাপনাতে এমন বিশেষ চুনাপাথরের ব্যবহার করা হয়েছে, যা সূর্যের আলোয় দেয়ালে তৈরি করে অনন্য আলোকছায়ার খেলা। জাদুঘরের উত্তর পাশের কাচের দেয়াল থেকে দেখা যায় দোহা উপসাগরের অসাধারণ দৃশ্য।
জাদুঘরের সংগ্রহশালায় রয়েছে প্রায় চৌদ্দশ বছরের ইসলামি শিল্প ও ইতিহাসের নিদর্শন। যেগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে স্পেন, মিসর, ইরান, ইরাক, তুরস্ক, ভারতসহ মধ্য এশিয়ার একাধিক দেশ থেকে। জাদুঘরের প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে সোনা, রুপা ও সিরামিকের কারুকাজ করা নানা জিনিস, কাচের তৈজসপত্র, গয়না, ক্যালিগ্রাফি, পাণ্ডুলিপি, টেক্সটাইল ও কাঠের অলঙ্করণ। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইসলামের প্রথম যুগের কোরআনের এক পাণ্ডুলিপি। আরও রয়েছে জ্যামিতিক আরবেস্ক নকশা খচিত ১৪ শতকের একটি মিম্বার।
কাতার বিশ্বকাপের আগে জাদুঘরটিকে নতুনভাবে সাজিয়ে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। যোগ করা হয় এগারোশর বেশি নতুন নিদর্শন, থ্রিডি ভার্চুয়াল গাইড এবং শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক বিভন্ন প্রোগ্রাম। জাদুঘরের গ্রন্থাগারে রয়েছে ইসলামি শিল্পকলা বিষয়ক হাজার হাজার বই ও দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি। রয়েছে নয়টি আলাদা স্টাডি রুম, যেখানে গবেষক ও শিক্ষার্থীরা নিরিবিলি পরিবেশে পড়াশোনা করতে পারেন।
জাদুঘরের ভেতরেই রয়েছে আইডিএএম নামের একটি রেস্তোরাঁ, যার রন্ধনপ্রধান হিসেবে নিযুক্ত আছেন বিশ্বখ্যাত শেফ আলান দুকাস। ফরাসি ও মেডিটেরেনিয়ান খাবারের পাশাপাশি এখানে শেখানো হয় রন্ধনশৈলীর নানা বিষয়। বিভিন্ন মেয়াদে রন্ধনশৈলীর ওপর কোর্স করানো হয় এখানে।
জাদুঘরের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে এমআইএ পার্ক। সব বয়সীদের জন্য উন্মুক্ত এই পার্কে রয়েছে শিশুদের খেলার জায়গা, বিভিন্ন খাবারের দোকান। আরো রয়েছে মার্কিন শিল্পী রিচার্ড সেরার তৈরি বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘সেভেন’। প্রতি সপ্তাহে এখানে বসে এমআইএ বাজার।
শুধু নিদর্শন নয়, শিক্ষার ক্ষেত্রেও জাদুঘরটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ২০২৪ সালে চালু হয় ‘চ্যালেঞ্জ ক্যাম্প’, যেখানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাতীয় ও ইসলামি মূল্যবোধ বিকাশে আয়োজন করা হয় নানা কর্মসূচি। এতে অংশগ্রহণ করে কাতারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান।
জাদুঘরটি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সক্রিয়। ফ্রান্সের ল্যুভরে ও নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টসের সঙ্গে যৌথ গবেষণা ও প্রদর্শনী করছে নিয়মিত। এছাড়াও অংশ নিয়েছে সৌদির দিরিয়া ইসলামিক আর্টস বিয়েনানে। ২০২৪ সালে চালু করেছে ‘মিউজিয়াম এস্কেপ রুম’, এটি একটি ইন্টারঅ্যাকটিভ শিক্ষা পদ্ধতি, যেখানে ইসলামি বিজ্ঞান, ক্যালিগ্রাফি ও ইতিহাস মিলেমিশে ধরা দেয় নতুন আঙ্গিকে।
ইসলামিক আর্ট মিউজিয়াম আজ কাতারের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের কাছে ইসলামি ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠ দূত হয়ে উঠেছে। অতীতের মহিমা আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় গড়া এই জাদুঘর যেন সময়ের গর্ভে গেঁথে থাকা এক জীবন্ত ইতিহাস।