১৫ মে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি: ১২ আগস্ট, ১৯৭১

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে একইসঙ্গে বেদনাদায়ক ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি অনেক দিন থেকেই প্রস্তুত ছিল, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। কিন্তু ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাত থেকে পাকিস্তানী হানাদার সেনাবাহিনী গোটা বাংলাদেশজুড়ে এমন এক নারকীয় গণহত্যা ও অকল্পনীয় নৃশংসতা চালিয়েছে, যার ভিত্তি রচিত হয়েছিল ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।

সাধারণ এ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের ১৬৭টিতেই জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের একক প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হন। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সংখাগরিষ্ঠ দলের নেতাও হন তিনিই । কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্ব সংখাগরিষ্ঠ দল  আওয়ামী লীগ ও তার নেতা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং  এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।

১৯৭১-এর ৭ মার্চ শেখ মুজিব এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, যার পর শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। তবে রাজনৈতিক এই সমস্যা সমাধানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় আলোচনা এবং ২৫ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে সেনাবাহিনীকে বেসামরিক বাঙালির ওপর অভিযান চালানোর নিদেশ দেয় পাকিস্তানের ইয়াহিয়া সরকার। রাতভর নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর চলে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। নারকীয় হত্যাযজ্ঞের এই রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানি সেনারা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়া বাঙালি সেনা, ছাত্র ও সাধারণ জনতার সমন্বয়ে গঠিত হয় একটি সামরিক বাহিনী। ২৬ মার্চ থেকেই প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। পরবর্তীতে ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার তথা মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়।

এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে পূর্ব পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সাবেক সদস্যরা ‘বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী’ গঠন করেন এবং জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী প্রধান সেনাপতি পদ গ্রহণ করেন। এই সময় ভারত বাংলাদেশকে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে। সাধারণ জনতা যুদ্ধকালীন সময়ে নিরলসভাবে এই বাহিনীকে সাহায্য করে। যুদ্ধের পর পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বাংলাদেশের সকল সেনা ও জনতার বাহিনীকে ‘মুক্তিবাহিনী’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়।

নয় মাসের এ মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ বাঙালিকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল । সেই সঙ্গে আরও ১ কোটি বাঙালি বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে। এছাড়াও লক্ষ -কোটি নিরপরাধ নারী-পুরুষ- শিশু পৈশাচিক ও বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে। গৌরবের এই ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যেমন বেদনার তেমনি শক্তির। যুদ্ধ চলাকালে সেই নয়মাস প্রতিদিন যুদ্ধক্ষেত্রে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। শহীদের রক্তে প্রতিদিনই রাজপথ ভিজেছে। বোনের সম্ভ্রম হারানোর চিৎকারে আকাশ প্রকম্পিত হয়েছে।

এই সবকিছু মোকাবেলা করে আমরা স্বাধীনতার দিকে এগিয়েছি। কিভাবে স্বাধীন হলাম, কেমন ছিল সেই পথ? কারা মিত্র ছিল, কিভাবে যুদ্ধে জয়ী হলাম, আর আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে কিভাবে বাংলাদেশকে দেখা হয়েছে, আমাদের কূটনৈতিক মিশন কেমন ছিল? এগুলোর সঠিক তথ্য আগামী প্রজন্মের জন্য ছোট করে তুলে ধরার প্রয়াস সমাজকালের পক্ষ থেকে।

 

প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তৎপরতা:

১. ঘটনাবহুল মুক্তিযুদ্ধে ১২ আগস্ট পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর উদ্দেশ্যে একটি চিঠি পাঠান প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। চিঠিতে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করার আইনগত, সাংবিধানিক বা অন্য কোনো অধিকার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নেই। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তির জন্যই বঙ্গবন্ধুকে বাঁচানো দরকার।’

২. এদিকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান মুজিবনগর থেকে এক বার্তা পাঠান। সেখানে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ এখন কেবল মুক্তিফৌজ ও দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এ যুদ্ধ এখন জনযুদ্ধে পরিণত হয়েছে। দেশবাসী হানাদারদের বিতাড়িত করে স্বদেশ ভূমিকে মুক্ত করতে বদ্ধপরিকর।’

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিক্রিয়া:

১. ১২ আগস্ট দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় ‘পাকিস্তানি বাহিনীর কৌশলগত পশ্চাদপসরণ’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন ছাপা হয়। সেখানে বলা হয়, ‘মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার সময় সম্প্রতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সামরিক বাহিনীর  সেক্টর কমান্ডারদের কয়েকজন মনে করেন যে,  মুক্তিবাহিনীর কমান্ডো ও গেরিলারা বেশ কয়েকটি এলাকায় অভিযান পরিচালনার সময় মুখোমুখি অবস্থানে থাকা পাকিস্তানি বাহিনীর সেনাদের তেমন সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। কমান্ডারেরা মনে করেন যে এটি কৌশলগত কারণ হতে পারে। এটা এখন স্পষ্ট যে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা গঠিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মূলত পূর্ব বাংলায় কাদা এবং কাঁটার ঝোপে সম্পূর্ণ হতাশ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে এখন প্রবল বৃষ্টির মৌসুম চলছে,  যা যুদ্ধের জন্য একেবারেই সহায়ক পরিস্থিতি নয়। সেনাবাহিনীর বর্তমান কৌশল হতে পারে বর্ষা পরবর্তী মৌসুমের জন্য তারা অস্ত্র ও শক্তি সংরক্ষণ করছে। বর্ষার পরে হয়ত তারা কঠিন আক্রমণ শুরু করবে।’

২. এদিন কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় ছাপা হওয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে  পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী  ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর সেনা তৎপরতা বাড়িয়ে তুলেছে। পাকিস্তানি জঙ্গিবাহিনী সীমান্তের ৬০টি চৌকিতে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করেছে। কিন্তু সেনাকমান্ডের নির্দেশ সত্ত্বেও নদী, জলপথ, পাহাড় দিয়ে বিস্তৃত ২৭০টি সীমান্ত ফাঁড়ির ওপর সফল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এখনো সফল হয়নি তারা। মুক্তিবাহিনী সমগ্র সীমান্ত বরাবর বাংলাদেশের ভেতরে ৫০ মাইল পর্যন্ত নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনেছে এবং নানা অঞ্চলে আরও অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছে।’

ভারতে তৎপরতা:

১. ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভার অধিবেশনে ১২ আগস্ট বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক সরকার কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিলে তা শুধু পূর্ববঙ্গেই হবে না, এর প্রভাব বিশ্বেও পড়বে। তাঁর নিরাপত্তায় এগিয়ে আসার জন্য আমরা বেশ কয়েকটি দেশকে অনুরোধ জানিয়েছি।’

এদিকে সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় এদিন ২০ মুসলিম সাংসদ যৌথ এক বিবৃতিতে বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়কে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বর্তমান পাকিস্তানের অবস্থান ও আদর্শ সম্পূর্ণভাবে ইসলামিক মূল্যবোধ ও আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নিরীহ মানুষের উপর নির্বিচারে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ কখনোই ইসলাম বৈধতা দেয়নি। তাই পাকিস্তানের সামরিক চক্রের গুরুতর এই কার্যকলাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান আপানারা।

২. কিন্তু এদিন ভারতীয় জনসংঘ দলের পক্ষ থেকে ইন্দিরা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ তোলা হয়। দিল্লিতে আয়োজিত প্রায় পাঁচ লাখ কর্মীর সমাবেশে যোগ দিয়ে জনসংঘের সভাপতি অটল বিহারি বাজপেয়ি এসময় বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দেওয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘ভারত-সোভিয়েত যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া গেছে। সেখানে বাংলাদেশ বা পূর্ববঙ্গের নাম নেই। অথচ পাকিস্তান সরকার নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে, ভারত সরকারের তাতে কোনো বিকার নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার চাপে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ভয় পাচ্ছে ভারত সরকার।’

৩. ভারতের কাশ্মীর থেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে এক টেলিগ্রাম বার্তা পাঠান কাশ্মিরের নেতা শেখ আবদুল্লাহ। সেখানে তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করা হলে সমস্যার সমাধান তো হবেই না, বরং তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে। এসময় ইয়াহিয়াকে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেওয়ার এবং সবার জন্য গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধানে আসার আবেদন জানান তিনি।

৪. ত্রিপুরার আগরতলায় ১২ আগস্ট দুটো শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন মার্কিন সিনেটের শরণার্থীবিষয়ক সাব-কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি। এরপর সাংবাদিকদের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচারের সম্মুখীন হওয়াটা নিন্দনীয়। আমরা শেখ মুজিবের বিচার বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাবো। আশা করি পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের যথাযথ শুভ বুদ্ধির উদয় হবে।’

৫. এদিন ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং দিল্লিতে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রক্ষায় মার্কিন সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের  সরকার কখনোই গোপন বিচারের পক্ষে নয় জানিয়ে মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে মার্কিন সরকারের অবস্থানও পরিষ্কার করেন তিনি। এসময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে, পাকিস্তান যদি তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে তবে মার্কিন সরকারের সমস্ত সহায়তা ও বন্ধুত্ব থেকে চিরস্থায়ীভাবে বঞ্চিত হবে পাকিস্তান।’

পাকিস্তানের তৎপরতা:

১. ইসলামাবাদে এদিন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ তোলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র । তিনি বলেন, ‘সোভিয়েত-ভারত চুক্তি অনেকাংশে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্র। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন উপদেশ দেওয়ার চেষ্টা করছে।’

২. এদিন পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী ব্রিটিশ মন্ত্রীদের সঙ্গে লন্ডনে এক বৈঠকে বসেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বর্তমানে যেসব অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে, তা সেনাবাহিনীর সৃষ্ট নয়। এর জন্য দায়ী সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীরা।’

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে:

১. এদিকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের এক মুখপাত্র বলেন, ‘শেখ মুজিবের বিচার সম্পর্কে জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এ নিয়ে এখন প্রকাশ্যে আলোচনা করবেন না মহাসচিব। এসময় জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন ১১ আগস্ট রাতে উ থান্টের হাতে শেখ মুজিবের বিচার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি চিঠি হস্তান্তর করেছেন বলেও জানান তিনি।

২. অন্যদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গোপন সূত্র একটি ১২ আগস্ট জানায়, গত মার্চে অস্ত্র সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও আরও প্রায় তিন কোটি টাকার সমরাস্ত্র পাঠানো হতে পারে। ‘মার্কিন সিনেটের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও জাহাজযোগে পাকিস্তানে আরো ৩ কোটি ডলার মূল্যের সমরাস্ত্র দেওয়া হতে পারে। আগের লাইসেন্সকৃত রপ্তানিকারকদের মাধ্যমে এ সমরাস্ত্র দেওয়া হবে।’

দেশজুড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ:

১. টাঙ্গাইলে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ১২ আগস্ট পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারেদের বিরুদ্ধে করটিয়াজুড়ে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এদিন মুক্তিবাহিনীর ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল মর্টারের গোলা ছুঁড়তে ছুঁড়তে মটরা সেতু দখল করে করটিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। এসময় মুক্তিবাহিনীর সামনে টিকতে না পেরে করটিয়ায় অবস্থানরত প্রায় ৩শ হানাদার সেনা ও রাজাকার প্রথমে করাতিপাড়া থেকে করটিয়া এবং পরে করটিয়া থেকে সরে গিয়ে বাংড়া ও পৌলির কাছাকাছি আশ্রয় নেয়।

২. ৮ নম্বর সেক্টরে হানাদার বাহিনীর পোটখালী ঘাঁটির ওপর এদিন অতর্কিত আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধাদের এ আক্রমণের মুখে পোটখালী ঘাঁটি  ছেড়ে পালিয়ে যায় হানাদার সেনারা। এসময় ঘাঁটি  দখল করে সেখানে প্রতিরক্ষা  ব্যুহ গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী।

দেশজুড়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের তৎপরতা:

১. এদিন খুলনায় সুন্দরবনের ভেতরে মুক্তিবাহিনীর লাওতাড়া ঘাঁটির ওপর দুদিক থেকে আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এ আক্রমণে মুক্তিবাহিনী পিছু হটে আশাসুনি থানার বড়দল ঘাঁটিতে ফিরে আসে।

২. ১২ আগস্ট ঢাকায় শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশ করা হয়। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনসুর আলীর পক্ষ থেকে প্রকাশিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে সবাইকে আজাদী দিবস পালনের আহ্বান জানানো হয়। সেখানে তারা বলেন, ‘ আমাদেরকে অবশ্যই দুষ্কৃতৃকারী ও বিছিন্নতাবাদীদের হাত থেকে দেশের আদর্শ ও অখন্ডতা রক্ষার জন্যে নতুন করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে।’

 

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র পঞ্চম, ষষ্ঠ, অষ্টম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।

দৈনিক পাকিস্তান, ১৩ আগস্ট ১৯৭১;

দৈনিক যুগান্তর, ১২ আগস্ট ১৯৭১;

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৩ আগস্ট ১৯৭১;

দ্য স্টেটসম্যান, ১২ আগস্ট ১৯৭১।