ভারত-পাকিস্তানের যত যুদ্ধ
সমাজকাল ডেস্ক:
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনা আবারও ভয়াবহ সংঘাতে রূপ নিয়েছে। ২২ এপ্রিল ২০২৫-এর পাহেলগাম হামলার পর বুধবার রাতে ভারতের পাল্টা অভিযানে পাকিস্তানের একাধিক সামরিক স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়। এতে অংশ নেয় ভারতের স্থল, নৌ এবং বিমান বাহিনী। এর পাল্টা জবাবে পাকিস্তানও প্রতিশোধ শুরু করেছে এবং ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত এই দুই দেশের মধ্যে এমন উত্তেজনা দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। কাশ্মীর ইস্যু ঘিরে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে সংঘাতপূর্ণ। ইতিহাস বলছে, দেশভাগের পর থেকে একাধিকবার দুই দেশ সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়েছে। নিচে এই যুদ্ধগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক বিবরণ তুলে ধরা হলো:
১৯৪৭: দেশভাগ ও কাশ্মীর সংকটের সূচনা
১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসনের অবসানের পর ভারত ও পাকিস্তান দুটি আলাদা রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়। দেশভাগের সময় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটে। এই সময় থেকেই কাশ্মীর নিয়ে বিরোধের সূচনা হয়। কাশ্মীরের তৎকালীন মহারাজা ভারতভুক্তির সিদ্ধান্ত নিলে পাকিস্তানের সঙ্গে প্রথম সামরিক সংঘর্ষ শুরু হয়। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ১৯৪৯ সালে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায় দুই দেশ। তখন থেকেই ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ নির্ধারিত হয়।
১৯৬৫: দ্বিতীয় কাশ্মীর যুদ্ধ
১৯৬৫ সালের আগস্টে পাকিস্তান কাশ্মীর পুনর্দখলের উদ্দেশ্যে অভিযান চালায়। প্রায় এক মাসব্যাপী এ যুদ্ধে উভয়পক্ষের কয়েক হাজার সৈন্য নিহত হয়। যুদ্ধ শেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায় ভারত ও পাকিস্তান।
১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও তৃতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ
১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনে নামে। পাকিস্তানি সেনাদের দমন-পীড়নের জবাবে ভারত সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। এই যুদ্ধের ফলেই বাংলাদেশ নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আনুমানিক ৩০ লাখ মানুষ নিহত হন এবং কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নেন। যুদ্ধটি মাত্র ১৩ দিন স্থায়ী হলেও এটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং চূড়ান্ত যুদ্ধ।
১৯৮৯-৯০: কাশ্মীর বিদ্রোহ ও দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনা
কাশ্মীরে রাজনৈতিক সংকট ও সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হলে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক আবারও উত্তপ্ত হয়। ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের অর্থায়ন ও অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ তোলে। এই সময় সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা বাড়ানো হয়।
১৯৯৯: কার্গিল যুদ্ধ
কার্গিল পর্বতে পাক সেনা ছদ্মবেশে ঢুকে পড়ে ও ভারতীয় চৌকি দখলের চেষ্টা করে। ভারত পাল্টা হামলায় অনেক এলাকা পুনর্দখল করে। ১০ সপ্তাহব্যাপী এ সংঘাতে উভয়পক্ষের প্রায় এক হাজারের বেশি সৈন্য নিহত হন। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক চাপে পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
২০১৯: পুলওয়ামা হামলা ও বালাকোট অভিযান
২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জম্মু ও কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপিএফ কনভয়ে আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জন সেনা নিহত হন। এর জবাবে ভারত পাকিস্তানের বালাকোটে বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তান পাল্টা আক্রমণে একটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করে এবং উইং কমান্ডার অভিনন্দনকে আটক করে, পরে তাকে শান্তির প্রতীক হিসেবে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
২০২৫: পহেলগাম হামলা ও অপারেশন ‘সিন্দুর’
২২ এপ্রিল ২০২৫ সালে ভারতের পহেলগামে এক সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হন। ভারত এর দায় পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে ব্যাপক সামরিক প্রতিক্রিয়া জানায়। ৭ মে রাত থেকে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর ও পাঞ্জাবে ভারত হামলা চালায়, যার ফলে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছে। পাকিস্তানও পাল্টা জবাব দিচ্ছে।
ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব এক দীর্ঘ ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। বারবার সাময়িক শান্তি এলেও কাশ্মীর ইস্যু ও সীমান্ত সন্ত্রাসবাদ উভয় দেশের মাঝে চিরস্থায়ী বৈরিতা সৃষ্টি করেছে। পারমাণবিক অস্ত্রের যুগে এমন সংঘাত শুধু উপমহাদেশ নয়, গোটা বিশ্বের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।