১৫ মে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ভারত পাকিস্তানের পানি থামাতে পারবে না

১৯৬৫, ১৯৭১ ও ১৯৯৯ সালের যুদ্ধেও বাতিল হয়নি সিন্ধু পানিচুক্তি
আলি তাহির

পাকিস্তানে কয়েক সপ্তাহ ধরে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক চলছে। মূল ইস্যু হলো পাঞ্জাবে সেনাবাহিনী-নিয়ন্ত্রিত বিশেষ বিনিয়োগ পরিষদ ও ‘সবুজ পাকিস্তান উদ্যোগ’ প্রকল্পের আওতায় চোলিস্তান অঞ্চলের জমি সেচের জন্য সিন্ধু নদে একটি নতুন ক্যানাল নির্মাণ।

এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে সিন্ধু প্রদেশে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সিন্ধুর ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, নাগরিক সমাজ, লেখক ও আইনজীবীদের বড় একটি অংশ একত্র হয়ে এই প্রকল্পের প্রতিবাদ করছেন। দিনের পর দিন বন্ধ রয়েছে সিন্ধু-পাঞ্জাব সীমান্ত, চলছে অবস্থান ধর্মঘট। তাঁদের দাবি—এই ক্যানাল নির্মাণ প্রকল্প অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।

এর মধ্যেই ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একধাপ এগিয়ে সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে—পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হামলার জের ধরে, যে হামলার জন্য ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করছে।

তবে, আমি বিশ্বাস করি—যতই কঠোর ঘোষণা দিক না কেন, ভারত পাকিস্তানের পানি বন্ধ করতে পারবে না। ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত সিন্ধু পানিচুক্তি আন্তর্জাতিক আইন ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে এখনো অটুট। এই চুক্তি ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালের যুদ্ধকালেও বাতিল হয়নি। এই চুক্তির অন্যতম মধ্যস্থতাকারী ও গ্যারান্টর বিশ্বব্যাংক।

ভারতের এই স্থগিত ঘোষণাটি মূলত ঘরোয়া রাজনৈতিক শ্রোতাদের তুষ্ট করার প্রচেষ্টা। যদি ভারত সত্যিই পাকিস্তানের পানির প্রবাহ বন্ধ করে, তাহলে তা পাকিস্তানের লাখ লাখ মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলবে।

২০১৯ সালেও মোদি সরকার এমন হুমকি দিয়েছিল এবং এখন আবার একই কৌশলে অভ্যন্তরীণ সমর্থন আদায় করতে চাইছে। বাস্তবতা হলো—সিন্ধু পানিচুক্তির আওতায় তিনটি নদী (সতলজ, বিয়াস ও রবি) ভারতের জন্য বরাদ্দ; এই নদীগুলোর পানি ভারত এককভাবে ব্যবহার করতে পারে।

কিন্তু এই নদীর পানির পুরোটাই ভারত ব্যবহার করতে পারে না, যার ফলে অবশিষ্ট পানি স্বাভাবিকভাবে পাকিস্তানে প্রবাহিত হয়। ভারত চাইলেও এই পানি আটকে রাখতে পারে না। অপরদিকে, ইন্দাস (সিন্ধু), চেনাব ও ঝেলম নদী পাকিস্তানের একক অধিকারভুক্ত—যার প্রবাহ বন্ধ করা ভারতের পক্ষে কার্যত অসম্ভব।

এমনকি, ভারত যদি নতুন করে পানি সরানোর অবকাঠামো নির্মাণ করতে চায়, তবু তা বাস্তবায়নে বছর বছর সময় লেগে যাবে। এটা রাতারাতি করা যায় না।

এই ছয়টি নদী ভারত থেকে পাকিস্তানে প্রবাহিত হয় এবং চুক্তির আওতায় দুই দেশ তিনটি করে নদীর একক ব্যবহারাধিকার পেয়েছে। অতীতে ভারত চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করেছে—১৯৯০ এর দশকে চেনাব নদীতে (যেটি পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ) একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করে এবং পরে কিশানগঙ্গা নদীতেও অনুরূপ প্রকল্প গ্রহণ করে।

আন্তর্জাতিক আইন স্পষ্টভাবে বলে—একটি দেশ তার অভ্যন্তরীণ নদীর প্রবাহ এমনভাবে পরিবর্তন করতে পারে না, যাতে অন্য একটি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯১১ সালের মাদ্রিদ ঘোষণা এবং জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ আইনেও এই নীতিমালার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।

এইসব নীতিমালার আলোকে ভারত, একটি উজান রাষ্ট্র হিসেবে, পাকিস্তানের সম্মতি ছাড়া নদীর পানি বন্ধ, দেরি বা পরিবর্তন করার অধিকার রাখে না।

তবে বাস্তবতা হলো—অনেক দেশই আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে, এবং ভারত-পাকিস্তান প্রসঙ্গে ভারতের অতীত রেকর্ড উদ্বেগজনক। তাহলে কি ভারত পাকিস্তানের পানি বন্ধ করতে পারবে? নজির রয়েছে। কিন্তু, করবে কি?

সম্ভাবনা নেই। কারণ, যদি ভারত এই কাজ করে, তাহলে তারা বিশ্বমঞ্চে “সুচিন্তিত ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্র” হিসেবে নিজেদের ভাবমূর্তি হারাবে। এমনকি পাকিস্তান বরং আন্তর্জাতিকভাবে সহানুভূতির পাবে—একটি আঞ্চলিক ‘হেজেমন’-এর দ্বারা আক্রান্ত দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—যদি ভারত পাকিস্তানের পানি বন্ধ করে, তাহলে সে নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ২০১৬ সালে উরি হামলার পর মোদি সরকার পানি বন্ধের হুমকি দিয়েছিল। প্রতিক্রিয়ায় চীন তিব্বতে ব্রহ্মপুত্র নদীর একটি শাখা আটকে দেয়, যার ফলে ভারতের পানিপ্রবাহ ব্যাপকভাবে কমে যায়।

যদি ভারত পাকিস্তানের পানি বন্ধ করে, চীন একই যুক্তিতে ভারতের বিরুদ্ধে এমন পদক্ষেপ নিতে পারে, যেখানে ভারতের কোনো নৈতিক অবস্থান থাকবে না।

উভয় দেশই কৃষিনির্ভর অর্থনীতি। পানি নিয়ে সংঘাত উভয়ের উন্নয়ন থামিয়ে দেবে। তাই ভারত কখনোই পাকিস্তানের পানি বন্ধ করবে না—না আন্তর্জাতিক আইনভঙ্গের ভয় থেকে, না কূটনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কায়।

ভারতের উচিত এই চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। একতরফাভাবে চুক্তি স্থগিত করা বা দায় এড়ানোর অধিকার তাদের নেই—এবং বাস্তবতাও নেই।

অনুবাদ: সমাজকাল ডেস্ক, পাকিস্তানের জিউটিভি থেকে
মূল লেখক: ব্যারিস্টার আলি তাহির