ট্রাম্প-জেলেনস্কি বৈঠক : শান্তির সম্ভাবনা, কিন্তু বিজয় নয়
সমাজকাল ডেস্ক :
পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর পর আয়োজিত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় এক নাটকীয় মোড় নেয় ইউক্রেন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক। রোমের ঐতিহাসিক সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় দাঁড়িয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে ১৫ মিনিটের একান্ত আলোচনা হয়। বহুদিনের দূরত্ব ঘোচানোর এই বৈঠককে জেলেনস্কি আখ্যা দিয়েছেন “সম্ভাব্য ঐতিহাসিক” হিসেবে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই আলোচনায় যুদ্ধের প্রকৃত অবসান ঘটার ইঙ্গিত মিললেও, এটি ইউক্রেনের জন্য কোনো প্রকৃত বিজয় নয়।
বৈঠকের তাৎপর্য
ট্রাম্পের সদ্য ঘোষণায় ইঙ্গিত মিলেছে যে, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ অস্ত্রবিরতি চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। ট্রাম্প বলেছেন, “রাশিয়া ও ইউক্রেন আলোচনায় ভালো অগ্রগতি করেছে। এখন উচ্চপর্যায়ের বৈঠক প্রয়োজন, যাতে সবকিছু চূড়ান্ত করা যায়। অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ইতিমধ্যেই সমঝোতা হয়েছে।”
এর আগে ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ মস্কোয় পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ধারণা করা হচ্ছে, সেই বৈঠকের ফলাফলের ভিত্তিতেই বর্তমান উদ্যোগ জোরদার হয়েছে।
ইউক্রেনের জন্য কঠিন বাস্তবতা
রিচার্ড ক্যাম্পের বিশ্লেষণ বলছে, যুদ্ধক্ষেত্রে অসাধারণ সাহসিকতা দেখালেও, ইউক্রেন আজ ক্রমশ দুর্বল অবস্থানে চলে এসেছে। যদিও কিয়েভে ড্রোন উৎপাদন ও অস্ত্র শিল্পে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, তবে পশ্চিমা সামরিক সহায়তা কমে আসায় ইউক্রেনের পক্ষে একা টিকে থাকা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে।
এমন পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের সামনে কার্যত কোনো বিকল্প নেই। ট্রাম্পের প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনা অনুসারে, ইউক্রেনকে রুশ দখলকৃত অঞ্চল — বিশেষ করে ২০১৪ সালে দখলকৃত ক্রিমিয়া — স্বীকৃতি দিতে না হলেও বাস্তবে সেই ভূমি হারানোর শর্তে শান্তিচুক্তি মেনে নিতে হতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিমিয়ার রুশ দখল মেনে নিতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
পুতিনের সম্ভাব্য কৌশল ও ইউক্রেনের ভবিষ্যত
পুতিনের জন্য এই চুক্তি একপ্রকার বিজয়ের বার্তা বহন করবে। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতি হলেও, একটি অস্ত্রবিরতি মস্কোয় রাজনৈতিকভাবে পুতিনের অবস্থান আরও শক্ত করবে। তিনি সহজেই এটিকে “রাশিয়ার জয়” হিসেবে প্রচার করতে পারবেন, যদিও রুশ জনগণের জীবনমান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অন্যদিকে, ইউক্রেনে জেলেনস্কির অবস্থান বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। যদি বিশাল ভূখণ্ড হারিয়ে একটি শান্তিচুক্তি হয়, তবে জনরোষের মুখে তিনি নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারবেন কি না, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন রয়েছে। পুতিন অবশ্য এর সুযোগ কাজে লাগাতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেই মনে করা হচ্ছে।
পশ্চিমা বিশ্বের ব্যর্থতা ও পরবর্তী সংকট
নেটো (NATO) এই যুদ্ধের সময়ে নিজেকে কার্যত একটি “কাগুজে বাঘ” প্রমাণ করেছে। ধারা ৫ অনুযায়ী প্রতিশ্রুতি থাকলেও, বাস্তবে কোনো ইউরোপীয় দেশ নিজেদের সৈন্য পাঠাতে রাজি হবে না, বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের কোনো নতুন হামলার মুখে। এই দুর্বলতা শুধু পুতিনকেই উৎসাহ দেবে না; চীন, ইরানসহ আরও অনেক স্বৈরশাসক শক্তি পশ্চিমের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হতে সাহস পাবে।
রিচার্ড ক্যাম্পের মতে, ইউরোপীয় দেশগুলোর এখন প্রয়োজন “সফট লাইফ”-এর অভ্যাস ভেঙে নতুন করে প্রতিরক্ষা খাতে বিশাল বিনিয়োগ করা এবং জনগণকে যুদ্ধ ও আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত করা। নইলে, ইউক্রেনের বর্তমান পরিণতি অচিরেই ইউরোপের অন্যান্য দেশের বাস্তবতা হয়ে উঠতে পারে।
বাস্তবতা কঠিন, বিকল্প প্রায় নেই
ট্রাম্প ও জেলেনস্কির সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় মুখোমুখি হওয়ার এই মুহূর্ত ইতিহাসে রয়ে যাবে — হয়তো গৌরবের জন্য নয়, বরং পশ্চিমা বিশ্বের নতিস্বীকারের একটি চিত্র হিসেবে। আজকের দিনে পশ্চিমের সামনে কোনো “ম্যাজিক সমাধান” নেই; যেকোনো বিকল্প শুধু রক্তপাত দীর্ঘায়িত করবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর এর চরম মূল্য চোকাতে হবে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষকেই।