জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতী ছত্রাক ‘অ্যাসপারজিলাস’
সমাজকাল স্বাস্থ্য ডেস্ক :
(স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে এই ফাঙ্গাস)
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইতোমধ্যেই আমাদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশকে নানাভাবে আঘাত করছে। তারই এক ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত হতে পারে ‘অ্যাসপারজিলাস’ (Aspergillus) নামক এক ছত্রাক, যা ক্রমশ ইউরোপের উত্তরাঞ্চলে ও অন্যান্য শীতপ্রধান এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। গবেষকদের মতে, এটি ভবিষ্যতে কোটি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
🦠 কি এই অ্যাসপারজিলাস?
অ্যাসপারজিলাস একটি ছাঁচ জাতীয় ফাঙ্গাস, যেটি মাটি, পচা গাছপালা, কম্পোস্ট হিপ, ধূলিকণা ও নির্মাণস্থলের মতো পরিবেশে সহজেই জন্মায়। এর কয়েকটি প্রজাতি যেমন Aspergillus fumigatus ও Aspergillus flavus মানুষের শরীরে শ্বাসনালীর মাধ্যমে ঢুকে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
প্রাথমিকভাবে এটি ফুসফুসে আক্রমণ করে এবং রোগের নাম হয় অ্যাসপারজিলোসিস (Aspergillosis)। তবে সংক্রমণ ধীরে ধীরে রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে কিডনি, মস্তিষ্ক বা হৃদযন্ত্রেও ছড়িয়ে পড়তে পারে, বিশেষ করে যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম – যেমন ক্যানসার বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনকারী রোগী।
🌡 জলবায়ু পরিবর্তন ও ফাঙ্গাসের বিস্তার
ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. নরমান ভ্যান রেইন এবং তার সহগবেষকরা একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় দেখিয়েছেন, বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়ার ফলে এই ছত্রাক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে উত্তর ইউরোপ, রাশিয়া, চীন, স্ক্যান্ডিনেভিয়া এবং উত্তর আমেরিকার আলাস্কা অঞ্চলে।
🧬 গবেষণার মূল তথ্য:
Aspergillus fumigatus ২১০০ সালের মধ্যে ৭৭% নতুন ভৌগলিক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
শুধু ইউরোপেই ৯০ লাখের বেশি মানুষ সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়বে।
Aspergillus flavus, যা শস্যে বাস করে, ১৬% নতুন কৃষিভূমিতে বিস্তৃতি ঘটাতে পারে, যা খাদ্যশস্যে ছত্রাক সংক্রমণের আশঙ্কা তৈরি করছে।
🧫 কেন মানবদেহে সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম এই ছত্রাক?
এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল মাইকোলজি সেন্টারের সহ-পরিচালক ড. এলেইন বিগনেল,নিয়েছেন:
“অ্যাসপারজিলাসের প্রাকৃতিক জীবনধারাই তাকে মানুষের ফুসফুসে টিকে থাকার জন্য প্রস্তুত করে তুলেছে। কম্পোস্টের ভেতরে যেমন উঁচু তাপমাত্রা থাকে, তেমনি মানবদেহের অভ্যন্তরেও প্রায় ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বিরাজ করে।”
এই ছত্রাকের স্পোর বাতাসে ভেসে বেড়ায় এবং শ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢুকে পড়ে। সবসময় এটি বিপজ্জনক না হলেও, যাদের শ্বাসযন্ত্র দুর্বল – যেমন হাঁপানি, সিস্টিক ফাইব্রোসিস রোগী বা ইমিউনো-কম্প্রোমাইজড ব্যক্তি – তাদের জন্য এটি মারাত্মক প্রাণঘাতী হতে পারে।
🚨 স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তার দ্বিমুখী হুমকি
অ্যাসপারজিলাস কেবল স্বাস্থ্যের জন্য নয়, বরং খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও এক বড় হুমকি। বিশেষ করে A. flavus জাতের ছত্রাক কৃষিজ ফসল – যেমন ভুট্টা, বাদাম, গম – এ সংক্রমণ ঘটায় এবং অ্যাফলাটক্সিন নামে এক ধরনের বিষ তৈরি করে, যা ক্যানসার পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারে।
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডেরিয়াস আর্মস্ট্রং-জেমস বলেছেন:
“এই ছত্রাক থেকে মানুষ যেমন মারা যেতে পারে, তেমনি খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাও ভয়ঙ্কর হুমকির মুখে পড়বে।”
🔬 চিকিৎসা ও গবেষণার সীমাবদ্ধতা
বর্তমানে কিছু অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ এই সংক্রমণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়, যেমন ভোরিকোনাজোল বা অ্যামফোটেরিসিন-বি। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, Aspergillus fumigatus অ্যান্টিফাঙ্গাল প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করছে, যা ‘সুপারফাঙ্গাস’ হয়ে উঠার আশঙ্কা তৈরি করছে।
✅ কি করা দরকার এখন?
জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিক উদ্যোগ, বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো।
ফাঙ্গাল গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি, যাতে নতুন ওষুধ উদ্ভাবন করা যায়।
ফসল সংরক্ষণ ও কৃষিকাজে ছত্রাক প্রতিরোধী প্রযুক্তি প্রয়োগ।
স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, বিশেষ করে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের জন্য নিয়মিত ফুসফুস পরীক্ষা ও চিকিৎসা গ্রহণ।
জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি ফলাফল হিসেবে ছত্রাকের বিস্তার স্বাস্থ্য ও কৃষির ওপর এক নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। এটি নিছক একটি সংক্রমণ নয় – বরং ভবিষ্যতের জন্য এক নীরব বিপদ। সময় থাকতেই সচেতনতা, গবেষণা ও নীতিগত হস্তক্ষেপ জরুরি।