গুয়েতেমালায় গবেষকরা প্রায় ৩ হাজার বছর পুরোনো একটি মায়া সভ্যতার জটিল স্থাপত্যের নিদর্শন আবিষ্কার করেছেন। পিরামিড, উপাসনালয় ও সুনির্মিত খালের নিদর্শন মিলেছে।
সমাজকাল ডেস্ক:
গুয়েতেমালায় গবেষকরা প্রায় ৩ হাজার বছর পুরোনো একটি মায়া সভ্যতার জটিল স্থাপত্যের নিদর্শন আবিষ্কার করেছেন। সেখানে মিলেছে পিরামিড, উপাসনালয় ও এক ব্যতিক্রমী খাল ব্যবস্থা—যা প্রাচীন মায়া সভ্যতা সম্পর্কে নতুন আলোকপাত করতে পারে বলে জানিয়েছেন দেশটির সংস্কৃতি মন্ত্রী।
উত্তর গুয়েতেমালার পেটেন অঞ্চলে অবস্থিত লোস আবুয়েলোস, পেতনাল এবং ক্যামব্রায়াল নামক তিনটি পৃথক স্থানে এই নিদর্শনগুলো মিলেছে। এগুলো মায়া সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র উয়াকসাকতুন-এর নিকটবর্তী।
দেশটির সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, লোস আবুয়েলোস, যার অর্থ ‘পিতামহ-প্রপিতামহ’, এলাকাটির নামকরণ হয়েছে সেখানে পাওয়া দুটি মানবসদৃশ শিলার ভাস্কর্যের ওপর ভিত্তি করে, যেগুলোকে একটি ‘আদি দম্পতি’র প্রতীক বলে মনে করা হচ্ছে।
গবেষকদের মতে, এই ভাস্কর্যসহ আশপাশে থাকা বেশ কয়েকটি পবিত্র উপাসনালয় ইঙ্গিত করে যে এটি মায়া ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল।
পেতনাল এলাকায় ৩৩ মিটার (১০৮ ফুট) উচ্চতার একটি বিশাল পিরামিড পাওয়া গেছে। এর চূড়ায় দুটি সংরক্ষিত কক্ষ রয়েছে যেগুলোর ভেতরের দেয়ালে বিভিন্ন প্রতীকচিত্র সম্বলিত চিত্রাঙ্কন রয়েছে।
ক্যামব্রায়াল নামক এলাকায়, লোস আবুয়েলোস থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে, একটি প্রাসাদের ভেতরে একধরনের ‘অনন্য’ জল প্রবাহব্যবস্থা বা খাল পাওয়া গেছে—যা মায়া স্থাপত্যে খুবই বিরল ঘটনা।
“এই তিনটি স্থান একটি পূর্বে অজানা নগর কাঠামোর ত্রিভুজ গঠন করেছে, যা আজ অবধি অজানা ছিল। এই আবিষ্কার মায়া সভ্যতার মহত্বের এক অসামান্য প্রমাণ,” বলেন দেশটির সংস্কৃতি উপমন্ত্রী লুইস রোদ্রিগো কারিয়ো।
এ আবিষ্কারগুলো গুয়েতেমালান ও স্লোভাক প্রত্নতাত্ত্বিক দল, আন্তর্জাতিক গবেষকদের সহযোগিতায়, ব্রাতিস্লাভার কোমেনিয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় পরিচালিত Uaxactún Regional Archaeological Project (PARU)-এর অংশ হিসেবে সম্পন্ন হয়েছে।
প্রত্নতত্ত্ববিদরা সম্প্রতি লেজার ম্যাপিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে মায়া সভ্যতার শত শত বসতি ও নগরের সংযুক্তি ও সমন্বয় চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন। এর আগেও ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে টিকাল নগরীতে একটি ১৭০০ বছর পুরোনো বেদি আবিষ্কৃত হয়েছিল, যাতে মানুষের হাড় পাওয়া যায়—তবে ধারণা করা হয় এটি মায়া শিল্পীদের তৈরি নয়, বরং দূরবর্তী টিওতিহুয়াকান অঞ্চলের শিল্পীদের কাজ।
এই সব আবিষ্কারগুলি মায়া সভ্যতার পরিসর, বৈচিত্র্য ও উন্নত নগর-পরিকাঠামো সম্পর্কে আধুনিক গবেষণায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিচ্ছে।
মায়া সভ্যতা: সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
মায়া সভ্যতা ছিল মধ্য আমেরিকার অন্যতম প্রাচীন ও উন্নত সভ্যতা, যা আনুমানিক ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিকশিত হতে শুরু করে এবং খ্রিস্টীয় ৯০০ শতকের মধ্যে তার শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছায়। বর্তমান মেক্সিকো, গুয়েতেমালা, বেলিজ, হন্ডুরাস এবং এল সালভাদরের কিছু অঞ্চলে এই সভ্যতার বিস্তৃতি ছিল।
মায়ারা ছিল অত্যন্ত উন্নত জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও স্থপতি। তারা জটিল ক্যালেন্ডার পদ্ধতি, হায়ারোগ্লিফ-নির্ভর লিখনপদ্ধতি এবং সুচিন্তিত নগর পরিকল্পনার মাধ্যমে বিশাল পিরামিড, উপাসনালয় ও প্রাসাদ নির্মাণ করেছিল। তারা উন্নত কৃষি ব্যবস্থার পাশাপাশি বিশাল causeway বা প্রাচীন “সুপারহাইওয়ে” গড়ে তোলে, যা বিভিন্ন নগর ও গ্রামের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করত।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও মায়া সভ্যতা ছিল অত্যন্ত আনুষ্ঠানিক ও আচারনির্ভর। দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে তারা রক্তপূজা থেকে শুরু করে মানব বলি পর্যন্ত করত। তাদের সমাজ কাঠামো ছিল শ্রেণিনির্ভর—যেখানে শাসক, পুরোহিত ও শিল্পী-শ্রমিকদের মধ্যে একটি স্পষ্ট বিভাজন দেখা যেত।
যদিও ৯০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে মায়া সভ্যতার কেন্দ্রীয় অনেক শহর ধ্বংসপ্রাপ্ত বা পরিত্যক্ত হয়, তবে কিছু অঞ্চল পরবর্তী কয়েকশ বছরও সক্রিয় ছিল। আজও মায়া জাতিগোষ্ঠীর বহু বংশধর মধ্য আমেরিকায় বাস করে এবং তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছে।
সিএনএন থেকে অনুবাদ করা হয়েছে।