১৫ মে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গণিতের রাজপুত্র কার্ল ফ্রিডরিখ গাউস

নাজিয়া আহমেদ নওশী :

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গণিতবিদদের একজন জোহান কার্ল ফ্রিডরিখ গাউস। তিনি ‘প্রিন্স অব ম্যাথমেটিশিয়ান্স’ হিসেবে খ্যাত। আজ থেকে ২৪৮ বছর আগে ১৭৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেছিলেন গণিতের এই রাজপুত্র। গাণিতিক বিশ্লেষণ, সংখ্যা তত্ত্ব, জ্যামিতি, সম্ভাব্যতা তত্ত্ব ও জ্যোতির্বিদ্যায় তার অসামান্য অবদানের জন্য তাকে আধুনিক গণিতের রূপকারদের অন্যতম হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।

গাউসের জন্ম জার্মানির ব্রাউনশভাইগ শহরের এক দরিদ্র শ্রমজীবী পরিবারে। তার মা ছিলেন নিরক্ষর। তিনি ছেলের জন্মদিন স্মরণ রাখতে পারেননি। শুধু জানতেন, তার সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল ইস্টার সানডের ৪০ দিন পরের বুধবারে। গাউস এই তথ্য ব্যবহার করে নিজেই জন্ম তারিখ বের করেন। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি ‘ইস্টার তারিখ নির্ণয়’ বিষয়ে একটি অ্যালগরিদম তৈরি করেন, যা তৎকালীন যুগে একটি গুরুত্বপূর্ণ গাণিতিক কৃতিত্ব হিসেবে বিবেচিত হয়।

গাউসের বাবা ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান মালী। তবে তিনি ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে অনিচ্ছুক ছিলেন। গাউসের মা ছেলের প্রতিভা সম্পর্কে জানতে পেরে তার শিক্ষার ওপর জোর দেন। শৈশব থেকেই গাউস অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। তিনি নিজেই বলতেন, তিনি কথা বলার আগেই গণনা করতে পারতেন। তার অসাধারণ প্রতিভা সম্বন্ধে বেশ কিছু গল্প প্রচলিত আছে। মাত্র তিন বছর বয়সে তিনি তার বাবার হিসাবের খাতার ভুল ধরে দেন মনে মনে গণনা করে। তার সম্বন্ধে আরেকটি বহুল প্রচলিত গল্প হলো, সাত বছর বয়সে একবার তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক দুষ্টু শিক্ষার্থীদের ব্যস্ত রাখার জন্য ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত সংখ্যাগুলোর যোগফল বের করতে বলেন। গাউস তার শিক্ষককে অবাক করে দিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই সঠিক উত্তরটি বের করে ফেলেন ৫০৫০!

তরুণ বয়সেই তিনি গাণিতিক সূত্র ‘ল অফ কোয়াড্রেটিক রিসিপ্রোসিটি’ প্রমাণ করেন, যা দ্বিঘাত সমীকরণ সমাধানে সহায়ক। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তার নাম পৌঁছে যায় রোমান সাম্রাজ্যের ব্রান্সউইক-উলফেনবুটেলের জ্ঞানী শাসক চার্লস উইলিয়াম ফার্ডিনান্ডের কাছে। ফলস্বরূপ ১৭৯১ সালে তাকে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হয়।

১৭৯২ সালে গাউস ভর্তি হন ইউরোপীয় অঞ্চলের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কোলেগিয়াম ক্যারোলিনামে। সেখানে গিয়ে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, কি নিয়ে পড়াশোনা করবেন, গণিত নাকি ভাষাতত্ত্ব? শেষে তিনি গণিতকেই বেছে নেন। তার বিখ্যাত উক্তি ‘বিজ্ঞানের রানি গণিত আর গণিতের রানি সংখ্যাতত্ত্ব।’

গাউসের প্রথম উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার ছিল ‘একটি ১৭ বাহুযুক্ত বহুভুজ কেবল স্কেল ও কম্পাস ব্যবহার করেই অঙ্কনযোগ্য।’ এই কাজের মাধ্যমে তিনি পলিনোমিয়াল সমীকরণ বিশ্লেষণের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন।

মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি লেখেন গাণিতিক গ্রন্থ ‘ডিসকুইজিশিনস অ্যারিথমেটিকি’। এই বই সংখ্যাতত্ত্বের আধুনিক ভিত্তি গড়ে দেয়। এই কাজের মাধ্যমে গাউস নিজেকে সময়ের শ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।

১৮০৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর এক চিঠিতে গাউস লেখেন, ‘এটা জ্ঞান নয়, শেখার প্রক্রিয়া। অর্জন নয়, পথচলা। এটাই প্রকৃত আনন্দ দেয়। যখন আমি কোনো বিষয়কে পুরোপুরি বুঝে নিই, তখন আমি তা ছেড়ে দিই। আর অজানার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি।’

১৮০৫ সালে গাউস বিয়ে করেন জোহান্না ওস্টহফকে। তাদের দুটি সন্তান জন্ম নেয়। কিন্তু চার বছর পর স্ত্রীর মৃত্যু হয়। এর পরের বছর মারা যায় তাদের ছোট সন্তান লুইস। এই দুই মৃত্যুর শোকে গাউস গভীর বিষণ্নতায় নিমজ্জিত হন, যা তাকে আমৃত্যু তাড়া করে বেড়ায়।

১৮১০ সালে তিনি বিয়ে করেন স্ত্রীর প্রিয় বান্ধবী মিননা ওয়ালডেককে। এই সংসারে তার আরও তিন সন্তানের জন্ম হয়। মিননাই পরিবারের দেখভাল করেন এবং গাউসের মানসিক স্থিতি ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হন।

১৮৩১ সালে গাউসের সঙ্গে উইলহেল্ম ওয়েবারের বন্ধুত্ব হয়, যা এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্ম দেয়। তারা একসঙ্গে কাজ করেন চুম্বকত্ব ও বৈদ্যুতিক বর্তনী নিয়ে। ওয়েবার ও গাউস মিলে তৈরি করেন বিশ্বের প্রথম ইলেক্ট্রোমেকানিক্যাল টেলিগ্রাফ। তারা গঠন করেন ‘ম্যাগনেটিচার ভেরাইন’ (Magnetischer Verein) নামে একটি বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণকেন্দ্র, যা পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র মাপার কাজ করে। তার এসব উদ্ভাবন এবং গবেষণার জন্য গাউস বিদেশি বিজ্ঞান একাডেমিগুলোর সদস্যপদ লাভ করেন। যেমন রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস এবং আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস।

গাউস শারীরিক ও মানসিকভাবে খুব শক্তিশালী ছিলেন। জীবনের শেষদিকে ঘুমজনিত সমস্যা ও বার্ধক্যজনিত কিছু অসুস্থতায় ভুগলেও কখনো মারাত্মকভাবে অসুস্থ হননি। ১৮৫৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

গাউসের মৃত্যুর পর তার মস্তিষ্ক সংরক্ষণ করেন বিজ্ঞানী রুডলফ ওয়াগনার। বিশ্লেষণে দেখা যায়, গাউসের মস্তিষ্কের ভর সাধারণের চেয়ে একটু বেশি এবং কর্টেক্সে বিশেষ গঠন ছিল, যা তার অসাধারণ মেধার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হিসেবে উপস্থাপিত হয়।

গাউসের মৃত্যুর পর তার সম্মানে বহু স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়। গোটিঙ্গেনে তৈরি হয় গাউস-ওয়েবার ভাস্কর্য। বার্লিনের পটসডাম ব্রিজেও তার স্মৃতি রক্ষার জন্য একটি ভাস্কর্য রয়েছে।

১৮৭৭ সালে তার জন্মশতবার্ষিকীতে জার্মানি জুড়ে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। পরবর্তীতে তার ছবি ছাপা হয় জার্মানির মুদ্রায় এবং ১৯৫৫ সালে মৃত্যু শতবার্ষিকীতে প্রকাশিত হয় তার মুখাবয়ব সংবলিত ডাকটিকিট।

লেখক : শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়